… যে মিস্টিসিজম এর আগে বাংলা
সাহিত্য পেয়েছে একমাত্র বিভূতিভূষণের লেখায়!
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে
আলাপ তো দূর, তাঁকে সামনে থেকে দেখার সুযোগই কখনও হয়নি আমার। আমি যে সময় কলকাতায় ফিরে
এসেছি, তখন তিনি খুবই অসুস্থ।
তবে আমি তাঁর অনেক গল্প শুনেছি।
সিনিয়র কথাসাহিত্যিকদের কাছে।
সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের
অক্ষরের সঙ্গে আমার আলাপ নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের মাধ্যমে। তাঁর লেখার মধ্যে
ওই উপন্যাসটাই আমি প্রথম পড়েছিলাম। আমার তখন ১৩-১৪ বছর বয়স হবে খুব বেশি হলে। ক্লাস
সেভেন এইটে পড়ি। ওই ম্যাগনিচুডের উপন্যাস বোঝার বয়স ওটা নয়। আমিও বুঝিনি। কিন্তু ঘোর
লেগে গিয়েছিল। মোহাবিষ্টের মতো আমি তখন শুধুই পড়ে গিয়েছিলাম। আমার শব্দভাণ্ডারে একটা
আশ্চর্য শব্দ যোগ হয়ে গিয়েছিল। এমন একটা শব্দ যা কোনওদিন ব্যবহার করতে পারব না আমি।
আবার ভুলতেও পারব না। সেই শব্দটার নাম ‘গাৎচোরেৎশালা’।
এই উপন্যাসটার শুরুতে আছে একটা
নতুন জন্মের কথা। আঘুনের শেষ বেলাতে ধনকর্তার ছেলে সোনার জন্ম হয়েছিল। আর উপন্যাসের
একদম শেষে আসে একটা মৃত্যুর কথা। সেই মৃত্যু তরমুজ খেতের মধ্যে ঈশম শেখের।
জন্ম থেকে মৃত্যু – তাঁর মাঝে
নীলকণ্ঠ পাখির মতো এক অলীকের খোঁজ করে যায় মানুষ। পায় না। শুধু সেই আবর্তে যোগ হয় খিদে,
ধর্ম, রক্ত, হিংসা ও রাজনীতির মতো নতুন মাত্রাগুলোর।
শুরু থেকেই এক অফুরান প্রকৃতির
কথা। ধানক্ষেতের অন্ধকারের ডিম পাড়তে আসা কচ্ছপ। সোনালি বালির নদীতে সূর্যের ডুবে যাওয়া।
তরমুজের খেত। বিল। শালুক-শাপলা, জলপিপি পাখিদের কথা। বাংলার নরম মাটির কথা। আরও নরম,
আরও আশ্চর্য গদ্যে।
চার্লস স্টুয়ার্ট, তাঁর ১৮১৩
সালে লেখা হিস্ট্রি অব বেঙ্গলের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “The province of Bengal was
one of the most valuable acquisitions that was ever made by any nation… Its
fertile soil produces everything requisite for the food of man and animal; and
in such abundance that the crops of one year are sufficient for the consumption
of its inhabitants for two.”
এত প্রাকৃতিক সম্পদ, এত প্রাচুর্য,
তা তো সবার জন্য নয়! এই প্রকৃতির অনুষঙ্গেই আসে খিদের কথা। স্নিগ্ধ শাপলা – একটু নুন
আর অল্প তেঁতুল গোলা দিয়ে অমৃত হয়ে ওঠে জালালীর কাছে। শাপলা তুলতে গিয়ে জলজ লতাপাতায়
আটকে গিয়ে মারা যায় জালালী।
জালালীর মতোই জোটন। কিংবা মালতি।
আবার এই প্রকৃতির মধ্যেই উঠে
আসে ধর্ম আর রক্তপাতের সম্পর্ক। ঘাসের ওপর বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরে পড়ে বলি দেওয়া মোষের
মাথা থেকে। সেই মাথাটাই পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে ভীষণ অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে গিয়ে থামে বিলের
মধ্যে কাজ করা গরিব মানুষের পায়ের কাছে।
মুড়াগাছার জমিদারবাড়িতে এই
মোষের বলির রক্ত নিয়েই মানুষের উন্মত্ততার দৃশ্য দেখতে পায় সোনা।
অফুরন্ত প্রকৃতির বুকে খিদে,
ধর্ম আর রক্তের অনুষঙ্গে ধীরে ধীরে চলে আসে ফেলু, আকলুদ্দিন জব্বররা। মালতি যেন হয়ে
ওঠে এই জ্বলন্ত সময়ের সব থেকে বড় ভিকটিম। দাঙ্গায় স্বামীকে হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল
সে। সেই গ্রামেই আবার লালসার শিকার হতে হয় তাঁকে। অসুরনাশিনী দুর্গার ভাসান হয়ে যাওয়া
মূর্তির মতো মৃতপ্রায় সে ভেসে এসেছিল নদীতে। আবার খিদের তাড়নায় সেই মালতিই হয়ে উঠল
চাল-পাচারকারী। ধরা পড়ে মাঠের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে শুয়ে পড়ে সে। বাবুটিকে
প্রলুব্ধ করে। তারপর অতর্কিতে কামড়ে ধরে তাঁর কণ্ঠনালী।
এই ট্র্যাজেডিরই আরেক ভিকটিম
ঈশম। আল্লার বান্দা সে। অথচ রাজনীতির এই জটিল আবর্তে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে।
প্রেম, যৌনতা, রাজনীতি, হিংসা,
ধর্ম, খুন আর সব কিছু ছাপিয়ে মানুষের এক চিরায়ত অলীক নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ – সব কিছুই
ধরা, সব কিছুই বলা। অথচ কী ভীষণ নরম করে। একটা অদ্ভুত মিস্টিসিজম দিয়ে। যে মিস্টিসিজম
এর আগে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে একমাত্র বিভূতিভূষণের লেখায়!
বাংলা উপন্যাসে ইতিহাস-ধর্মী
উপন্যাস লেখার এক বিরাট ধারা আছে। তাঁর সমকালীন লেখকরাও লিখেছেন। অথচ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
নিজে বলেছিলেন, আমার যখন বর্তমান আছে অতীতে যাব কেন? কী আশ্চর্য, সেই বর্তমান দিয়েই
বাঙালি জীবনের সাম্প্রতিক অতীতের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাকে ধরে রেখেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিরুচ্চার, আশ্চর্য অনাশক্তি দিয়ে। অদ্ভুত এক মিস্টিসিজম দিয়ে।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছিলেন,
পথের পাঁচালির পর এই হচ্ছে দ্বিতীয় উপন্যাস যা বাংলা সাহিত্যের মূল সুরকে অনুসরণ করেছে।
এই মিস্টিসিজমই যেন ধরা পড়ে
সাদা আম্বুলেন্স-এ। পক্স হওয়ায় দীর্ঘ দিনের মনিবের বাড়ি থেকে রাস্তার নিম গাছ তলায়
আশ্রয় নিতে হয় গরিব ভৃত্যকে। এমন প্লট অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে পরে বহু বাঙালি লেখকই
ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই নিমগাছের তলাতেই বারবার আসে একটা সাদা আম্বুলেন্স। রোগীকে
তুলে নিয়ে যেতে চায় হাসপাতালে। অথচ সেখানে পক্সের জন্য কোনও আলাদা ওয়ার্ড নেই। তাই
আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায় ওই গাছতলাতেই। এই সাদা আম্বুলেন্সও যেন ওই নীলকণ্ঠ পাখির মতোই
এক মিস্টিক মেটাফর। এমন কিছু যাকে প্রবল ভাবে পেতে চায় মানুষ। কিন্তু তা অলীক। পাওয়া
যায় না। এই গল্পের শেষে লেখক ক্রমশ যেন বাস্তবকে ছেড়ে এক অবাস্তবের দিকে চলে চান। দুই
পথশিশুকে নিয়ে ওই মুমূর্ষু রোগি ফিরে যায় তাঁর ছেড়ে আসা মনিবের বাড়ির সামনে। এবং দেওয়ালের
চারপাশে লিখে রাখতে লাগল অদ্ভুত একটা লেখা – ‘বড় মাঠে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যে যার চাষবাস
করতে লেগে যাও। সবুজ চারায় ছেয়ে যাবে। ফুল ফুটবে ফল হবে। দিনমানে পৃথিবীর জায়গা বদল
করে নাও।‘
না পরাবাস্তব বা কুহক নয়, চূড়ান্ত
আশাবাদও নয়। আমার মতে ওটা যেন আসলে একটা বিভ্রম। লেখকের নির্মাণ করা ইচ্ছেকৃত এক বিভ্রম।
যেখানে তিনি বাস্তবকে আর মেনে নিতে চাননা, তাই ইচ্ছাকৃত এক বিভ্রম নির্মাণ করেন।
এমন আরও আশ্চর্য সব গল্পের
কথা মনে পড়ছে যেমন – পোকা মাকড়েও খায়, বাঁচে, ভুখা মানুষের কোনও পাপ নেই, কাফের।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যাওয়ার
পর বাংলা এবং সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে। তিনি মহীরূহের
মতো লেখক। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই একটা আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ল।
এমনকি বাংলা লেখাগুলোতেও। তাঁর বিরাট সাহিত্যকীর্তির বিস্তারিত উল্লেখই নেই বেশিরভাগ
লেখায়। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, মানুষের ঘরবাড়ি, ঈশ্বরের বাগান, অলৌকিক জলযানের মতো এমন
মহাকাব্যের মতো সব উপন্যাস লেখার পরেও এমন হয়? হতে পারে?
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো
বিরাট মাপের ঔপনাসিক নিজের জানিয়েছেন যে প্রথম সারির দুটো পত্রিকার শারদ সংখ্যায় কখনও
উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ পাননি তিনি। ছোট গল্পের জন্য আমন্ত্রণ পেতেন অবশ্য। সাহিত্য
অকাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন ছোট গল্পের জন্যই। তিনি নিজেই বলেছিলেন, মেইন লাইনের লেখক
হতে পারেননি। কর্ড লাইনের লেখকই থেকে গেলেন।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অতীন প্রসঙ্গে
লিখেছিলেন, আজ হয়ত তিনি নিঃসঙ্গ যাত্রী, কিন্তু বিশ্বাস করি একদা আমাদের বংশধরগণ তাঁর
নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা অনুভব করে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তিরস্কার বর্ষণ করবেন।
এর থেকে সত্যি কথা বোধহয় আর
কোনও কিছু হতে পারে না।
No comments:
Post a Comment