চার
অধ্যায়
১
চুরাশি
চুম্বনে খশা পাপড়িটিকে আজ পেয়ে যাই
গ্রন্থের
ভিতর। সিদ্ধাচার্য আমি নই, নই সেই
পদকর্তা—একটি
পদ্মের বুকে শিখি নি চৌষট্টি
ডানার
উড়াল। লিপ্সাহত এই জীবনের তুচ্ছ
ভণিতায়
আমি জীবনপা, মৃত্যু-গোধূলির চর।
তুলোট
পৃষ্ঠার ভাঁজে পড়ে থাকা ছেঁড়া পাপড়ি তাই
ছুঁয়ে
দেখি। চটে গেছে রঙ তার, মিলিয়েছে গন্ধ,
শুয়ে আছে
যেন এক ফুলের ফারাও, মমি হয়ে—
কত কীট আর
কাঁটাবন পেরিয়ে সে এল তবু
স্তব্ধতার
মুখে তুলে দিতে এক ফোঁটা সম্ভাষণ।
অনেক
শব্দের ঢেউ ভেঙে ছুটে আসা, খুব মৃদু
ধ্বনিটির
ইঙ্গিতেও যে নির্ভুল সাড়া জাগে মনে,
যেমন
সম্ভব আজও গড়ে নেয়া, মর্ম-মূর্তি নয়,
স্মৃতির
টুকরো আলো পথে পথে কুড়াতে কুড়াতে
শৈশবের
একটি ম্যুরাল, তেমন কি হতে পারে—
ছড়াবে
শরীরবৃন্তে তোমার স্পন্দন, স্পর্শ ছাড়া?
যদিবা
ছড়ায়, জেনো, সেই উড়ন্ত ডানার ছায়া
পড়ে না
মাটিতে এসে—যে ডানা রোদ্দুর-শূন্যে লীন।
২
অয়ি
চণ্ডি, তোমাকেই বাঞ্ছা করি—হরিতকী, জবা,
শালবনে
নয়, জনারণ্যে। ডাকে ত্রাসপাখি ওই।
রাত্রির
নিশ্বাসে, ধ্যানে মগ্নঘুম স্তনের চূড়ায়
আততায়ী
জোছনার ফণা—তার চেয়ে উদ্বেলিত
এই
চাওয়াটুকু, জানি আমি, আত্ম-বিনাশীও বটে।
পাতার
আড়ালমোচী ফুল তীব্রগন্ধি বলেই কি
নয়
সর্বনাশ-পন্থি? প্রেমিকের হাত ছেড়ে তাই
আর কারো
হাতে লিখে নিল সেও, আঁচলে দস্যুতা।
দস্যু রত্নাকর
আমি নই। তুচ্ছ ব্যাধের জীবন
কাটে
পৃথিবীতে। ক্রৌঞ্চ সাক্ষী, আমি সেই কালকেতু,
শিকারির
বেশে এসে যে নিজেই হয়েছে শিকার।
একটি গোসাপ
ধরে ঘরে এনে দেখি—ফেলে দিয়ে
ছদ্মবেশ,
ফুঁসে ওঠে বিষাক্ত সাপিনী। ফণা তুলে
ডাকে : ‘আয়।’
ভাবি, আজ ভয় কাকে, যদি শিখে থাকে
বিষহর
চুম্বনের কলা—ওই রূপসন্ন্যাসিনী?
অথচ সে
কেন দাঁড়ায় না ঘুরে, যে মানুষ পারে
উল্টোরথ
টানা! চণ্ডি, এই চণ্ড-চাঁড়ালের দেশে
তোমারই আসন
মানি, কবি আমি, নিজ-চণ্ডী-দাস।
৩
আয়ুরেখা
মুছে মুছে এতটা এসেছি। ভয়ে ভয়ে।
পুষ্প বা
পাদুকা—কোনো চিহ্নই রাখি নি পিছে ফেলে।
সূর্যাস্ত
কি ফেলে গেল কিছু—চুনশাদা বালুচরে?
মন্থর স্রোতের
টানে থেমেছে ইঞ্জিন—যেন তারই
পূর্বাভাস
পেয়ে। একে একে ভেসে যায় নৌকাগুলি
শেয়ালের
ধর্ম জেগে ওঠা থমথম কাশবনে।
বাতাসে
গুটিয়ে হাতা, গগনশিরীষ এল কবে
ছোট্ট
জানালার পাশে! বিস্মৃতির মৃদু ঘ্রাণঝরা
সময় মোমের
মূর্তি—জ্বলে ওঠে, তাই গলে যায়।
অঙ্গুলিহেলনে
শুধু, এই ধূর্ত পৃথিবী এখন
কাছ থেকে
নগ্নিকাই দেখে নেয়। দেখাতে কি পারে?
নির্বাক
বাদুড় যতদূর ওড়ে—ছেয়ে ফ্যালে হিম
তমসায়। তমস্বিনী,
কার হাত ধরে পার হব
এ রাত্রির
গুহা—অমাময়ী মা আমার! ভয়ে ভয়ে
এখানে
এসেছি। আয়ুরেখা মুছে মুছে। তাই আর
পুষ্প,
পাদুকার কোনো চিহ্নই রাখি নি পিছে ফেলে।
পাথুরে
চোয়াল ঠেলে, শুনতে পাই, এতদিন পর
গম্ভীর
দেয়াল ডাকছে আমাকেই নাম ধরে—‘আয়’।
৪
মাছকে
সাঁতার শেখালাম আমি, পাখিদের গান,
দিলাম
মেঘের বুকে ওড়বার মন্ত্র। তবু জলে
হেঁটে
যেতে নিজেকেই অবিশ্বাস। তোমাকেও দেখি
পার হও ‘তরাসিয়া’
উপবন কলার ভেলায়।
দেবি,
তুমি পার হও তরঙ্গিয়া। সে তরঙ্গে যায়
ভেসে ঘট,
ডুবন্ত ঘাটের থেকে। এই দিকে আমি
থেরগাথা খুলে
নিয়ে খানিকটা ঘুমাবার আগে
গাবসন্ন্যাসীর
মতো মহানিমগাছ-তলে এসে
ভাবি,
কোথা থেকে আসে এই গন্ধ, ছাতিম ফুলের?
শ্রমণেরা
গিয়েছিল কবে তার নাগাল পেরিয়ে?
বারুদস্তম্ভিত
পৃথিবীর থেকে এমন দুপুর
যতদূরে
থাক, সেই তারাকুঞ্জ থেকে রাত্রিবেলা
উড়ে চলে
যাওয়া শাদা হাঁস তার দেখা পেয়েছে কি?
তোমার
মুখের দিকে ফিরে তাকালেই যদি সব
বোঝা যেত,
কাঠবিড়ালির পিছে পিছে এতদূর
আসবার
মানেই ছিল না। থাকতাম চুপচাপ
অর্জুন
ফুলের মতো সম্ভ্রান্ত যোনির কাছে বসে
ডাকতাম
ইশারায় বরুণ ফুলের হাসিটিরে...
No comments:
Post a Comment