বাংলা
ভাষার দাবি ও মুজতবা আলি
প্রতিবার ভাষা দিবস আসে আর সালাম, রফিক, বরকত,
জব্বরদের কথা স্মরণেই শেষ হয় দিবস পালন। খুব বেশি হলে আলোচিত হয়,
১৯৪৮ এর ১৯ মার্চ ঢাকার নাগরিক সংবর্ধনায় 'উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'
ঘোষণা করে বিক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানে আগুনে ঘৃতাহুতি
দেওয়ার প্রসঙ্গ।
এর পাঁচদিন
পর ১৯৪৮ এর
২৪ মার্চ জিন্না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে একই কথা ঘোষণা করেন। দুটো সভাস্থলেই
দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত
বাঙালী নেতৃত্ব জিন্নার বক্তৃতায়
বাধা দেন।
সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন
তাঁদের অন্যতম। মাতৃভাষার এই আন্দোলনই বাঙালিদের হৃদয়ে প্রকৃত এক জাতিসত্ত্বার ঊন্মেষ
ঘটায়। তার পথ ধরেই ১৯৬১ তে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন, ১৯৬৯ এর সাংবিধানিক সংগ্রাম তারপর ১৯৭১
এর মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত পথ বেয়ে স্বাধীনতা।
কিন্তু ভাষার আন্দোলনের
জথা প্রায় অনালোচিত থেকে যায় সৈয়দ মুজতবা আলির নাম। মুজতবা কেবল ব্যঙ্গ
সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ
লেখকই ছিলেন না; তিনি এক
রোমাণ্টিক, কাহিনীকার ও ভাষাবিদ
হিসেবেও সুপরিচিত।
খুব কমজনই ভাষা আন্দোলনের তার ভবিষ্যৎদর্শী ভূমিকার কথা জানেন। সকলেই জানেন, সমকালীন
বাংলা সাহিত্যে বরেণ্য নাম
মুজতবা আলি দেশে
বিদেশে’, ‘চাচা কাহিনী’, ‘শবনম’, ‘পঞ্চতন্ত্র’,
‘ময়ূরকণ্ঠী'র মতো তিরিশটি
গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলাকে
আমাদের রাষ্ট্রভাষা করার দাবির প্রথম
উত্থাপকদের মধ্যে
মুজতবা আলি
অন্যতম। ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধবার অনেক আগেই তিনিই প্রথম বলেছিলেন যে, উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা
হলে পাকিস্তান দু-টুকরো হবে। কোনও রাজনৈতিক
নেতা এই ভবিষ্যদবাণী প্রথম উচ্চারণ করেননি, করেছিলেন সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলি।
স্মরণীয়, ১৯৪৭এ ভারত
বিভাগের আগে কিছু মুসলমান পণ্ডিত ও বিদগ্ধজন মুসলিম ভারতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা
বা যোগাযোগের
মাধ্যম হিসাবে উর্দূকে ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন
করেন।
তাদের এই দাবির পিছনে ছিল ব্রিটিশ
শাসকদের উসকানি। যদিও ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের
লখনউ অধিবেশনে
বাঙালী মুসলমান নেতারা সেই দাবি
প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তার পরের ঘটনাবলী সকলেই জানেন
এবং জিন্না উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। গর্জে ওঠে বাংলা।
জিন্না উর্দূকে
রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করেন ১৯৪৮-এ, কিন্তু মুজতবা আলি সরকারের অভিসন্ধী,
সেই গূঢ় ষড়যন্ত্র টের পেয়েছিলেন এক বছর আগেই। ভাষা
আন্দোলনের ভাবনাও তখন
আসেনি। পাকিস্তান তৈরি হওয়ার তিন মাস পরে, ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সৈয়দ মুজতবা আলি সিলেটে মুসলিম সাহিত্য সংসদের
এক সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। রক্ষণশীল
লোকজন সে সময় তাঁকে হয়রানি করেছিল ও হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। কিন্তু অদম্য মুজতবা দীর্ঘ
তিন ঘণ্টা ধরে সাহসিকতার সঙ্গে যুক্তি সহকারে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছিলেন এবং নিজের
জ্ঞানলব্ধ বক্তব্য ত্যাগ
করতে অস্বীকার
করেছিলেন।
সেই হুমকি ও ধমকের মুখেও মুজতবা
আলি যে
দৃঢ়তার সঙ্গে একথা বলেছিলেন যে, আমাদের জনগণকে তাদের
মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করতে দেয়া উচিত। জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, রাষ্ট্রভাষার ছদ্ম আবরণে উর্দূ বা অন্য কোনও বিজাতীয় ভাষা বাঙালীদের
ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন,
উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে জনগণের
ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে আমাদের
শোষণ করার আরও একটা
হাতিয়ার তুলে দেওয়া হবে।
এর দু বছর পর অধ্যাপক
হুমায়ুন কবীর দ্বারা সম্পাদিত
'চতুরঙ্গ' পত্রিকার ১৯৪৯
সালের অগাস্ট (১৩৫৬ বঙ্গাব্দর শ্রাবণ) সংখ্যায় তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা’
শীর্ষক
একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ”আজ যদি জোর করে পোপের ভ্রান্তাদর্শ অনুসরণ করে উর্দূওয়ালারা পূর্ব পাকিস্তানের
স্কন্ধে উর্দূ চাপান,
তবে লুথারের মত লোক পূর্ব পাকিস্তানে খাড়া হবেন। যাঁরা অখণ্ড পাকিস্তান চান, এই কথাটি
ভেবে দেখবেন।“
এই 'অখণ্ড পাকিস্তান' প্রসঙ্গে আরেক
পর্যায়ে খোলাখুলি
লিখেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্বেও
যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপান হয় , তবে স্বভাবতই উর্দূভাষী বহু নিষ্কর্মা শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার চেষ্টা করবে এবং ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।"
তার এই কথাগুলি
যে কতটা সত্য ছিল, তা ১৯৫২ ও তার পরবর্তী কালের ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে যে, মুজতবা আলি কতটা
ভুয়োদর্শী ছিলেন। কত আগেই তিনি জোর করে বিজাতীয় ভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে চাপানোর ফলাফল
অনুমান করেছিলেন। অন্য কেউ বলার আগেই সারা দুনিয়া
চষে ঘুরে
বেড়ানো জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট এই মানুষটি বলেছিলেন যে, সারা বিশ্বের মানুষ নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত
করার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় খুঁজে পেয়েছে মাতৃভাষাতেই। তিনি আরবদের ইরান ও তুরস্ক বিজয়
থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন
যে, বিজয়ীরা সেইসব
দেশে যেমন ফার্সি
বা তুর্কী ভাষার ওপর আরবি ভাষা চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, ঠিক যেমন মুঘলরাও ভারতে
ফার্সি ভাষা চাপিয়ে দিতে পারেনি।
এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হয়, আলি
সাহেব তখন থাকতেন বগুড়ায় । তার এক বছর আগে বেরিয়েছে তাঁর প্রথম সাড়া-জাগানো বই ‘দেশে-বিদেশে’
। প্রকাশক নিউ এজ পাবলিশার্স । কিন্তু তার মতাদর্শের কারণে নিজের জেলা সিলেটের মানুষের হাতেই
তাকে হেনস্থা হতে হয়েছিল। এর কারণ বুঝতে হলে তৎকালীন সিলেটের কথা বলতে হয়। ব্রিটিশের
চাতুরীর কারণে সিলেট তখন ছিল আসামের অংশ, পূর্ববঙ্গের অংশগুলির মতো ছিল না। জেলাটি
পূর্ব পাকিস্তানের অংশ না হকেও গণভোটে অংশ নিতে বাধ্য হয়। সেখানে
সিলেটিরা বিপুল সংখ্যায় পাকিস্তানে যোগ দেয়ার
পক্ষে ভোট দেয়। তা সত্ত্বেও
ব্রিটিশরা জেলাটিকে অন্যায়ভাবে ভাগ করে। সিলেটেরই একটি মহকুমা
করিমগঞ্জকে ভারতে সংযুক্ত করা হয়,
যা সেলেটিদের মনে
আঘাত হানে। হাজার হাজার পরিবার তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ
হয়। রক্ষণশীল শাসকচক্র জনতার এই অনুভূতিকে উন্মাদনার কাজে লাগায়। মুজতবার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
সিলেটের সেই সভার পর ব্যথিত মুজতবা কলকাতা এসে তাঁর সেই বক্তব্য চতুরঙ্গতে ছাপেন।
১৯৪৮ এর
১২ ডিসেম্বর বগুড়ায় এক সাহিত্য সভায় সভাপতি হিসাবে আমন্ত্রিত মুজতবা আলি দুটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ
দেন। তাতে অভিভূত স্থানীয়
আজিজুল হক কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকরা মুজতবাকে কলেজের
প্রিন্সিপালের
দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানান। তারা কলকাতাতেও গিয়ে মুজতবাকে শেষ
পর্যন্ত অধ্যক্ষের পদে যোগ দিতে রাজি করান। ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে উত্তপ্ত সময়ে তিনি কলেজে যোগ
দেন। আন্দোলনের বারুদ শুকোচ্ছিল,স্থানীয় ছাত্ররা জড়িয়ে
পড়ছিল। পাশাপাশি, শহরের রক্ষণশীল মহল মুজতবা আলি বিরুদ্ধে
চক্রান্ত শুরু করে। অল্প
কিছুদিন পর কলেজের বার্ষিক কিছু ছাত্র
ম্যাগাজিনে ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রদের ওপর পুলিশের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে
নিবন্ধ লেখে। সেই সব লেখা নির্বাচিত
হয়েছিল মুজতবা
অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনেক
আগেই। তাসত্ত্বেও
মুজতবাকে ‘পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে নিবন্ধ লেখায় ছাত্রদের প্ররোচনা'র অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। করেছেন।’
ম্যাগাজিনটি
নিষিদ্ধ করে তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করা
হয়।
মুজতবা অকৃতদার
ছিলেন, থাকতেন তার দাদা, বগুড়ার ডিস্ট্রিক্ট
ম্যাজিস্ট্রেটের
তাঁর দাদাকেও জড়ানোর চেষ্টা করে। এই একমাত্র কারণেই আহত মুজতবা আলি অধ্যক্ষের
দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাসের মধ্যেই কলকাতায়
ফিরে এসেছিলেন।
No comments:
Post a Comment