প্যাভলভের ঘন্টা: অতিচেতনার ধ্বনি
এলার্ম বাজছে। ঘুমচোখ। কিন্তু হাত ঠিক
পৌঁছে যাচ্ছে ঘড়ির কাছে। হাতড়ে বেড়াচ্ছে। অচেতন একটা মন কাজ করছে ইঙ্গিতের। তাকে
তো কেউ বলেনি অনুসরণ করো এই পথ? যাও থামাও জাগরণের শব্দটিকে! তবে এখানেও মুখ্য হয়ে
দাঁড়াচ্ছে ধ্বনি। শব্দ। যাকে অনুসরণ করা যায়, এগোনো যায়। ভ্রম হতে পারে। মিথ্যে
হতে পারে। আর এটাই শব্দের যাত্রাপথ। যে শব্দ শুনে বহুবছর আগে একটা কুকুরের লালা
মাপছিলেন এক মনোবিজ্ঞানী। আর আমরা পেয়েছিলাম আশ্চর্য কিছু তথ্য। পরে স্কুলজীবনে
হোস্টেলে দেখেছি, লাঞ্চ- ডিনারের ঘন্টা বাজত। আর আমরা থালা হাতে, বাটি হাতে
দাঁড়িয়ে পড়তাম লাইনে। খিদে না পেলেও চনমন করে উঠত খিদে। এটা কী নিয়ম! অনু শাসন!
তার এতদিন পরে যখন পাঠ্যপুস্তক থেকে হারিয়ে গেছেন প্যাভলভ এবং তাঁর কুকুরের
পরীক্ষা, হঠাৎ করেই বেজে উঠল সেই হারিয়ে যাওয়া ঘন্টা। যেন সমগ্র জাতিকে ঝাঁকিয়ে
দিয়ে বলে যাচ্ছে-- এখন ঘুম ভাঙার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তুমি ঘোরের মধ্যে আছ?
আর তখনই বেদ মন্ত্রের মতো পুবের আকাশে বেজে উঠল শব্দ---
"ভিক্ষাপাত্রে পৃশ্নির আহ্বান
নিয়ে হে ক্ষুধা
অতিনিবেশ ভুলে যেও না
.....
.....
.....
প্যাভলভের ঘণ্টা বাজলে জিভে
জল তো আসবেই "
জল মাত্রই জীবন। বাঁচিয়ে তোলা। জল মাত্রই প্লাবন। ধ্বংস।
ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেন স্বাভাবিক এই ধ্বংস এই সৃষ্টি। একহাতে যেন দেবকী দাঁড়িয়ে
আছেন স্নেহমন নিয়ে, আদরের কোল সাজিয়ে জীবনের জন্য। অন্যদিক তখন ভাবছে ' বহুক্ষণ আলোয় থাকার পর অন্ধকারে/ প্রবেশ করার মতো আমাদের অদেখা গুলি/
চলো সাবাস বলি"। আর এটাই স্বাভাবিক। এটাই কাল প্রবাহ। শূন্য যেমন সত্য,
স্থিতিও অধিক সত্য। শুধু স্বাভাবিকভাবেই স্বাগতম জানানোটাই মুখ্য আলোক; আকর্ষণ।
আমরা যদি কল্প রূপে ধরে নিই হিংসা অন্ধকার,লোভ অন্ধকার, দ্বেষ তখনই আলোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দরকার পড়ে শক্তির। সেই শক্তি--
যাকে অজস্র তেজরশ্মি মিলিত হয়ে তৈরি করেছে। শক্তিপুঞ্জ। মহাকর্ষ। গতি। কেন্দ্র তখন
আলো--- সূর্য। ঝকঝকে রোদ। ঝলসে উঠছে ' তাই রুদ্রদেবতার শতমুখ'।
কবি অরিজিৎ চক্রবর্তী কী জানেন কোথায়
তাঁর যাত্রাপথ? কোনদিকে মোড় নিচ্ছে তাঁর খোঁজ? কোথায় বা সেই stream of
consciousness. তাঁর ২ নং কবিতাটিতে যখন প্রবেশ করি দেখি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।
অস্থির মন ব্যাখ্যা খুঁজছে। চাঞ্চল্য প্রকাশ করছে। অস্থির মন সেই আলো অন্ধকার
মণ্ডিত ছায়াপথের সন্ধান পেতে উৎসুক। কিন্তু পথ যে তার অজানা। অচেনা। কোনদিকে যাবে
সে? কাকে অনুসরণ করবে? শুধু ধ্বনির ইঙ্গিতে মেপে নেবে পথ? ততক্ষণে যেন প্রবেশকারী
প্রবেশ করতে চলেছেন বাস্তব রূঢ় দৃশ্যে। চোখ ঝলসে উঠছে। কালো কালো অন্ধকার খেলা
করছে ওই " Ethnological Notebooks" এ। আর তখন এসে দাঁড়াচ্ছে কবির ভাবনার
গভীরতা,
'......
নবম শতকের বাঙালিরা যে ভাষায় কথা
বলতেন,
সেই আবহটব পূর্ব জনম মনে করিয়ে দিল...
ভাবলাম নিবারণ সুন্দরীর পুথি অতীব
মনোরম ও পবিত্র
কারণ, যত নিসর্গ কল্পনার; তার
প্রবেশের দরজায়
দেখা গেছে নিভৃত প্রস্থান... "
ধনতন্ত্রের বিকাশ, আধুনিক যুগের
উত্তরণ আর তার সঙ্গে মিশে গেছে আমাদের প্রাচীন সভ্যতা- রীতিনীতি। 'মেহেরগড়ের
প্রত্নখননের মতো তোমার উৎকর্ষ ভাবিনি সেদিন'। এখানে সময় যেন যাজ্ঞবল্ক্য মুনি।
হ্লাদিনীর ভাঙা ছাদে খোঁজ চলছে সেই মায়াবিনী ধ্রুপদের। আর কবিও যেন এই খোঁজের
খাতায় নাম লিখিয়েছেন নিজের। কোন দিক থেকে ভেসে উঠবে সেই 'সত্য অথবা মিথ্যে
নির্দেশ'। যাইহোক একটা পথ চাই-ই। এই স্থিরতা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। এই অস্থির মন
যে আর তর সয় না।
দিকভ্রান্ত। অথচ, বেজে যাচ্ছে ঘন্টা।
অথচ, পথের নিশান জানা নেই। কোনদিকে মোড় নেওয়া যেতে পারে দিব্য শিহরণে! এই নদী
ভেঙে, বন জঙ্গলের আড়াল ভেঙে, গানের রেওয়াজ ছেড়ে, গৃহপালিত সংসার, মায়া, প্রেম,
ইশারা-- আকুল 'আমি' খুঁজে যাচ্ছে রাস্তা, পথ। পৌঁছতেই হবে ওই শব্দের কাছে। সত্যের
কাছে। 'ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ' কিন্তু তাঁর কাছে অধিক সত্য 'জাতস্য হই ধ্রুবো
মৃত্যু:'। আর তাঁর এই দার্শনিকতাকে তুলনা করা যায় ওমরের কিছু লাইনের সঙ্গে--
" Into this Universe, and why
not knowing
Nor whence, like Water willy-nilly
flowing:
And out of it, as Wind along the
Waste,
I know not whither, willy-nilly
blowing." ( ২৯ নং, অনুবাদ- ফিটজজেরাল্ড)
জিজ্ঞাসা ভেঙে কোথায় দাঁড়াবে মানুষ?
কোথায় বা ভাঙবে প্রশ্নের এলার্ম। কখন থামবে শব্দ। কিন্তু দালানে তো ঘন্টা ঝুলছে।
আর
"
......
.....
......
মানুষ ও মৃত্যুর মাঝে বেদনাচিহ্নের
মহাজগৎ ...
পাঁচালের গাজনে জিভবাণ সদৃশ
আবাহন, ত্যাগের পা ধুয়ে দিচ্ছে...
কান্তারবাসিনী উপাখ্যান ও কাহিনীর
নগরী
কৃতজ্ঞ পয়ারে ঘুমিয়ে হাসছে...
মনে হচ্ছে, জীবন আমার সমাধিক্ষেত্রের
মেনহীর
ব্যর্থতার বোধসহ কৃষ্ণচূড়া গাছ"
আর এ পথ কবিকে দিচ্ছে হতাশা। কষ্ট।
নিরাশার দোলাচল। কিন্তু পরাজয় মেনে নেননি তিনি। বরং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে
বলছেন, কূটচালের কথা। গোপন রহস্যে কবিকে থামিয়ে দিচ্ছে সেই অদৃশ্য অন্ধ শক্তি। আর
তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলছেন, রাতটুকু। জাস্ট একটু সময়। তারপর ভোর। আলো। শক্তির
ইশারা।কেননা, তিনি বিশ্বাস করেন,
" মানুষ মরে না, তাকে চক্রান্ত
সূচক মেরে ফেলা হয়
আমি শ্মশান জাগানো
আমার ত্যাগ আর ভোগের গল্প প্রতিদিন
একই সূর্যের উৎস্রোত"
স্বাভাবিকভাবেই এরপর আসে কবির খোঁজ
প্রাপ্তির কথা। গ্রামে ফেরেন। কিন্তু ততদিনে এখানেও ক্ষয়, শৈশব মুছে গেছে-- জীর্ণ ভাবে এসেছে বয়েসের গন্ধ। মায়ের হাতে
বানানো জন্মদিন, পায়েস--- প্রৌঢ়ত্বের ছায়া। কবির মনে অস্বাভাবিক ভাবেই এসে যাচ্ছে
মৃত্যু ভাবনা। হরিধ্বনি বাজছে দূরে; ডেঁয়ো পিঁপড়েরা আসছে মৃত্যুর দূত হয়ে। ঠিক
তখনই খেয়াল হয় ঘন্টা বাজছে। ডাক এসে পৌঁছচ্ছে। এ ধ্বনি মন্দিরের নয়, এলার্মের ঘুম
জাগানো নয়--- অজানা পথের। ' অজানা বিশালতায় বণিকপ্রিয়/ হেঁটে চলা বিকেলের
সাংসদে"।
Shakespeare তাঁর নাটক 'As You Like
It' বলেছিলেন,
" All the world's a stage/ And
all men and women merely players/ They have their exits and their
entrances." । 'প্যাভলভের ঘন্টা' কাব্যগ্রন্থটির শেষ পর্যায়ে এসে দেখি যেন
সেই যাত্রাপথের নিশানা খুঁজে ফেরা অস্থির কবি শান্ত, স্থির। জীবনের সত্যকে
অস্বীকার করেন না তিনি। শুধু একের পর এক দৃশ্যের ভেতর হেঁটে যান। খোঁজেন। সেই শব্দ
তাঁর কাছে আর অস্থিরতা এনে দেয় না। চাঞ্চল্য ভেঙে কবি নিরূপণ করতে পেয়েছেন ঘন্টার
আসল উদ্দেশ্য। তিনি বিধেয় রূপে নিজেকে রেখে যেতে চান। ঘন্টা বাজুক। সবাই ছুটুক ওই
ধ্বনি সন্নিকাশে। সন্ধিক্ষণে এসে তারা নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে সেই ধ্বনির মর্মস্থল।
কবি যেমন খুঁজে পেয়েছেন সেই 'কোকমুখা দুর্গার বশংবদ ঠিকানা'। কিন্তু এই পথ যে
সবাইকে নিজের মতো করে খুঁজতে হবে। পেতে হবে। কিন্তু কবি কাউকে কিছু বলছেন না।
দিচ্ছেন না পথের সন্ধান। এটি যে একান্তের খোঁজ। আত্মোপলব্ধির খোঁজ। নিজেই নিজের
চালক এখানে। ঘন্টা তো নিমিত্তমাত্র। অনুসন্ধিৎসু মনটিই এখানে পথপ্রদর্শক। ওই-ই
দেখাবে পথ। তুমি হাঁটো, হাঁটো। হেঁটে যাও যতক্ষণ না অন্ধকার নেমে আসছে মৃত্যু
রূপে। এটাই একমাত্র সত্য। এটাই পথ। কিন্তু এখন সন্দেহ হতে পারে, আসলে কী কবি খুঁজে
পেয়েছেন সেই পথ! তাই তিনি নিপুণ ভাবে বর্ণনা করেছেন সেই বর্ণাতীতের। শব্দের।
" দেহলোকে রক্ত যেমন তঞ্চিত হয়
ঠিক তেমনই এক অনুভবে জানলাম
সাপের বিষে তঞ্চকরোধক প্রতিতুলনায়
কীভাবে আগামীর ভিতর প্রবিষ্ট হচ্ছে
অতীত" ....
No comments:
Post a Comment