যে ভাষা সন্ত্রাস থেকে দূরে
‘রাজনৈতিক শিক্ষার
সবচেয়ে ফলপ্রদ দিক হলো সংবাদপত্রের ফুলিয়ে
ফাঁপিয়ে সংবাদ পরিবেশনার দিকটা। সংবাদপত্রই হলো রাজনৈতিক আলোকসম্পাতের প্রধানতম হাতিয়ার। এটা প্রাপ্ত বয়স্কদের
জন্য এক রকমের স্কুলও বলা চলে। এই শিক্ষা কর্মকান্ডটি
সরকারের হাতে থাকে না। এটা থাকে তাদের হাতে চরিত্রের দিক থেকে যারা অতি নিম্নস্তরের। যৌবনকালে ভিয়েনায় থাকাকালীন
এইসব মানুষের সংস্পর্শে
আসার সুযোগ হয়েছিল, যাদের হাতে এই লোকশিক্ষার যন্ত্র, তাদের মাধ্যমে এর আদর্শও জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হতো। প্রথমে তো আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কতো ক্ষুদ্র সময়ে এই ভয়ঙ্কর শক্তিধরটি
জনসাধারণের মধ্যে কোন বিশেষ একটা বিশ্বাস উৎপাদন করে। একটা হাস্যাস্পদ তুচ্ছ
ঘটনাকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনতে সংবাদপত্রের
মাত্র কয়েকদিন সময়ের প্রয়োজন হয়। যে মাধ্যম
জাতির পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোন একটা সমস্যাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা, অপহরণ বা অন্য কোন উপায়ে জনসাধারণের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে
রাখে।
সংবাদপত্রের আরো একটা ভানুমতীর খেলা হলো কোথা থেকে একটা নাম খুঁজে পেতে এনে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলা। আগে হয়তো কেউ সে নাম শোনেওনি। তারা নামগুলিকে এমনভাবে
জনসাধারণের কাছে উপস্থাপিত করে যেন সেই নামগুলির সঙ্গে জনসাধারণের অনেক আশা জড়িয়ে আছে। তারা নামটাকে জনপ্রিয়তার
এতোটা উঁচু ধাপে টেনে তোলে যা সত্যিকারের কোন ক্ষমতাসম্পন্ন
নেতার পক্ষে সারাজীবনেও
সেই জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব নয়। এই সমস্ত করা হয়, যদিও এই
সব নামগুলো হয়তো বা মাসখানেক আগেও অশ্রুত ছিল এবং কেউ উচ্চারণ পর্যন্ত করতো কিনা সন্দেহ
, সংবাদপত্রগুলো এগুলোকে খ্যাতির পাহাড়ের চূড়ায় টেনে তোলার আগে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন এবং ক্লান্ত রাজনৈতীক
জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের
প্রতিষ্ঠিত লোকেদের নাম এই সংবাদপত্রগুলো জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি
থেকে ধীরে ধীরে আবছা করে এনে শেষে একসময়ে ভুলিয়ে দেয়, যেন তারা
মৃত। … সংবাদপত্রগুলির অনিষ্ট করার ক্ষমতা যে কতো দূর, সঠিকভাবে বুঝতে হলে বিশেষ করে কুখ্যাত ইহুদী সংবাদপত্রগুলোকে অনুধাবন করা উচিৎ।’
বারবার পড়ছিলাম
কথাগুলি। বেশ কয়েকবার পড়বার পর, অস্বীকার করবার উপায়
নেই, নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি আমি এই
লেখাটির লেখকের নাম ও কীর্তি না জানতাম তা হলে কি আমি আরও বেশী প্রভাবিত হতাম না লেখাটির
দ্বারা? হতাম হয়তো। কারণ লেখাটির মধ্যে কোনও আফিমখোর সৈনিকের
চাঁদমারির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার লক্ষণ নেই। যদিও আমার পড়া বাংলা তর্জমায়, তবু আশা করা যায় বাংলায় যেটুকু ধরা গেছে
তার থেকে নিশ্চিত অনেক বেশী ভাষার-স্বচ্ছতা ছিল মূল লেখাটিতে। এটি একটি ক্যাপ্টেনের বক্তব্য। আপনি পড়া মাত্র এই ক্যাপ্টেনকে বিশ্বাস করে ফেলতে পারেন, কারণ পাঠপদ্ধতির ভেতর দিয়ে ততক্ষণে ক্যাপ্টেন
আপনার মগজে ঢুকে যেতে শুরু করেছেন। আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন, এই ক্যাপ্টেন আপনাকে ডুবন্ত জাহাজে ফেলে পালাবেন না। যে ভাষায় তিনি কথা বলছেন, সেই ভাষা আপনার চেনা। গোপনে কোথাও কি আপনিও এই যুক্তির পথই অনুসরণ করেন না? সেই যুক্তি, যেখানে
এসে ম্লান হয়ে যায় সব শিল্পের পথ ও শুভবোধ। কারণ আপনি এখন, এই মুহুর্ত থেকে যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিশ্লেষণ
করবার পথে হেঁটে চলেছেন। এই যুক্তির দরজা আপনার সামনে খুলে দিয়েছে, আপনার জেনারেল। এখন থেকে তিনিই আপনার মগজের চালক, হৃদয়ের সারথী। এই পৃথিবীতে সোনালি ডানার চিলের দিকে
চেয়ে কেউ কেঁদে উঠেছিল কিনা সেদিকে আপনি আর তাকাতে চান না। কোন বিপন্নতা থেকে বধূ ও শিশুর পাশ
থেকে উঠে একটি মানুষ অশ্বত্থের ডালের কাছে চলে গিয়েছিল, সেই বিপন্নতার দিকে আপনি আর তাকিয়ে দেখতে
চান না। কিংবা বলা ভালো, তাকিয়ে দেখার চেষ্টা
করলেও শুধু পাঁশুটে এক প্রান্তর ছাড়া আপনার চোখে আর কিছুই ধরা পড়ে না।
তার মানে এটা
নয় যে আপনি পড়েননি, ‘মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের
স্রোত ভালোবাসে’। পড়েছেন, কিন্তু এখন আপনি ভাষা-সন্ত্রাসের দাস হয়ে
গেছেন। ফলে ভাষার যে-দিকটা ‘সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের’ সন্ধান দেয়,
সেই দিকটা চাঁদের উলটো দিকের মতো আপনার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে শুরু
করেছে।
আপনি বুঝতেই পারেন
না আর, ভাষা ‘মধুরতম’ উপায়ে সন্ত্রাস ছড়িয়ে
দেয়। প্রচলিত, খালি-চোখে সে সন্ত্রাসকে দেখা যায় তাকেই স্বাদু ম্যারিনেট করে ও চেরি-টপলিং করে আপনার প্লেটে হাজির করে ভাষা। এই সন্ত্রাসই আপনাকে দিয়ে বলিয়ে নেয়
১. চারদিক থেকে ঘিরে লাইফ
হেল করে দেব
২. গুড়-বাতাসা খাইয়ে চড়াম চড়াম ঢাকের বোল শোনাব
৩. মারব এখানে, লাশ পড়বে কালীঘাটে
এবং
৪. মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি
সামান্য হেরফের হতে পারে উক্তিগুলির, কিন্তু এগুলি আপনার বা আমার ভাষায় কেউ-না-কেউ বলেছেন।
ভাষার অপরিমেয়
ক্ষমতার একটি দিক হল, সে দর্শনে মুড়ে ফেলতে পারে সন্ত্রাসকে। ভাষার যুক্তি আছে। যদিও, বোধের যুক্তি পেরিয়ে আরেকটি স্তর আছে। ভাষা, বোধের সেই স্তরটিকে ছুঁতে যেমন সাহায্য
করে, অনেক সময়ে সেই স্তরটির থেকে আপনার মুখটিকে ফিরিয়ে রাখতেও
সহায়তা করে। আপনার-আমার মাতৃভাষাও তার
বাইরে নয়। প্রথমে সে আপনাকে টেনে আনে তার ফাঁদে, তারপর বিশ্বাস করায় ও তারও পর সে নিজের তৈরী করা কাঠামোয় আপনাকে
কথা বলতে বাধ্য করায়। আর একবার আপনি সেই ভাষায় কথা বলতে শুরু করলে ক্ষমতা প্রকাশের সেই ভাষাই হয়ে ওঠে আপনার মাতৃভাষা। প্রতিদিন আপনি সেই ভাষাতেই কথা বলে যান। জগতে আনন্দযজ্ঞে, আপনার ভাষা ঘৃতাহুতি করে। যজ্ঞের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে। আপনি ঋত্বিকের মত যুক্তি সাজান অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রয়োজনীয়তার।
অনেকেই ভাবতে
পারেন, ২১ ফেব্রুয়ারী,
ভাষা-দিবসের দিনে এই কথার অর্থ কী। অর্থ একটাই, উপরের লেখাটির লেখক
অ্যডলফ হিটলার, বইটির নাম মাইন ক্যাম্ফ। কারাগারে বসে লেখা একটা বই। সংবাদপত্র ও তার চরিত্র নিয়ে হিটলারের বিশ্লেষণ অকাট্য। বেশ জোরালো ও যুক্তিপূর্ণ। সবটুকু পড়তে পড়তে বেশ ঘোর লেগে যায়। এই যে অংশটি, সেখানে তিনি
ইহুদী সংবাদপত্রগুলির দিকে আঙুল তুলেছেন। কিন্তু তার আগে তিনি যুক্তির বেড়াজাল দিয়েছেন
। এই বইটিও তার মাতৃভাষাতেই লেখা। কিন্তু তারপরও এই বইটিকে আমি আমার-বাড়িতে-বই রাখার
যে জায়গাগুলি আছে তার সবথেকে অন্ধকার কোনটিতেই রাখি। মনে হয়, হয়তো কোনও দিন এই বই থেকে একটা রক্তচোষা
ড্রাকুলা বেরিয়ে এসে আমার কথামৃত আমার রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনানন্দের উপর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত উগরে দেবে। রক্তবমি করবে আমার প্রিয়তম বইগুলির
উপর।
নোয়াখালী থেকে হাসনাবাদ … ছড়িয়ে থাকা বাংলাই আমার মাতৃভাষা। এই একুশের ভোর আমাকে যেন শেখায়, আমার বাংলাভাষা যেন ড্রাকুলার আশ্রয় না হয়ে ওঠে। তার মুখ থেকে যেন ভাষা সন্ত্রাসের রক্ত না ঝরে। যার সম্ভবনা কিন্তু পুরোমাত্রায় দৃশ্যমান…
* মাইন ক্যাম্ফ / অ্যডলফ হিটলার
অনুবাদ – পরিতোষ মজুমদার
দে’জ
No comments:
Post a Comment