Tuesday, February 19, 2019

কুন্তল মুখোপাধ্যায়-এর একগুচ্ছ কবিতা







বিবাহ

আসলে তোমার কথা কানে এলো তখনই যখন
মৃত্যুর খবর হয়ে ছড়িয়ে পড়েছ চারিদিকে
হে তরুণ মৃত ঠিক তখনই তো বিয়ে দিনক্ষণ

স্থির হল তাহেরুল তোমার বিধবা হবে , তুমি
মৃত বর , ও-সাফিন , বয়সে ও মৃত্যুতে তরুণ
সেইমত মালা এলো ফুল এলো , সুগন্ধী , মরশুমি

বাসনা পোড়ার গন্ধ চারিদিকে সূর্যাস্ত এখন
বিবাহ সানাই হয়ে কার যেন কান্না শোনা যায়
মুখে-হাত-চাপা ভিড় , শোকবাড়ি , আত্মীয়স্বজন

মৃত বর জীবিতের ? এ কেমন কল্পনা তোমার ?
আসলে তো মৃত বলে জীবিতেরও ঠিক নেই কোনও   




পৃথিবী আমার
পৃথিবী আমার যেন রোগীটির শেষের ক’দিন
দু’চোখ গড়িয়ে যার জল পড়ে পাতা নড়ে কই ?
লিঙ্গ বের হয়ে যায় বারেবারে নিয়ন্ত্রণহীন

অজস্র মৃত্যুর দেশ চারিদিকে রুগ্ন কালকেতু
রাত্রিবেলা উল্কাপাত মূত্রত্যাগ , কাপড়েচোপড়ে
পৃথিবী আমার ভুল বকে চলে অক্ষমতা হেতু

খবর নিয়েছে রোজ ভাড়াটিয়া , মানুষ , বিষয়
সেও তো রাষ্ট্রের সংঘ , আসে কোনও গভীর বৈঠক
যেখানে রুগীটি নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়

রাত্তিরের দিকে শুনি কারা যেন ত্রিকালের শব
ঢাকা দিয়ে বসে আছে কারও যেন কান্না শোনা যায় 





নেতা

হরপ্পাপুরুষ আমি , ত্রাতা হয়ে বৃক্ষে স্বপ্নচূড়
বেবাক খিঁচিয়ে দিই , দাঁতগুলি পংক্তিবদ্ধ , সাদা
ইতিহাস থেকে রোগ নিয়ে আসি হিংসুটে প্রভুর

এ বৃক্ষ দর্শনমাত্র কেউ ভাবে সংসদভবন
কেউ ভাবে অসভ্যতা , কেউ ভাবে অনায়াস ধাঁধা
হুজুগপিয়াসী বৃক্ষ খোঁজ রাখে জনতার মন

সেই বৃক্ষে বসে আছি , ডালে ডালে ভৃত্যেরা তন্ময়
উন্নতিবিধানই লক্ষ্য , তদুপরি বক্তৃতাবাহার ...
জনতা সামান্যে ভোলে , তাহাদের স্বপ্নশিক্ষে হয় !

সেই গাছ আজ বেশ ফুলে ফলে হিংস্রতাবিহার
বিষবৃক্ষে ভালবেসে জল দেয় পবনপুত্রেরা




লেখা নিয়ে
রেয়াত করে না কেউ । তুমিও কি আজ বেপরোয়া ?
রক্ত নামে সিঁড়ি বেয়ে ,শব্দ নেই , সুভদ্র জিরাফ
আরও শান্ত আকর্ষণ । নিষেধেরা নিছকই ঘরোয়া !

শহরে এসেছে ফের শিশুমেলা , ঘোরানো বিমান ,
এক দেহে দুই শিশু পেট থেকে পা দুটি নড়েছে ...
সে নাকি দ্রষ্টব্য খুব  পশুদের মতো তার কান ...

পরোয়া করো না ? বেশ । কিন্তু প্রতিবন্ধী লেখা ,শোনো
দুমুঠো সার্কাসই দেয় । যা কখনও চিরায়ত নয় ...
দুদিনের বৈরাগী কি অন্ন হতে পেরেছে কখনও ?  

ভেবে দেখো , অযোগ্যেরা আলতু ফালতু সম্মানিত হলে
প্রখর প্রতিভা দেখে ঠারেঠোরে মুখ বেঁকিয়ে হাসে               




বসন্ত , রক্তচোর

তির ,এসো , বিদ্ধ করো , হৃৎপিণ্ড আমার বেওয়ারিশ
বহুদিন আগে কেউ খুলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল
একহাতে লাগিয়েছিল হৃৎক্ষতে নীচু নেলপালিশ

তির আমি রক্তপাতে স্বাভাবিক ; ছুরি ও ড্যাগার
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । পক্ষাঘাতে অকৃপণ । দেখ
ফুসফুসও আগুনমুখো , হাওয়া দেয় রোগা কর্মকার    

জমানো আমার পাখি পুড়ে গিয়ে সিদ্ধ হয় নুনে
হৃৎকমলিনী তাতে জুড়ে দেয় বিভিন্ন সবুজ
আমার হৃৎপিণ্ড এসে পড়ে যায় বিষাদ উনুনে ...

তির আমি অসহায় । তির আমি কষ্ট খুলে দেখি
আমার সমস্ত রক্ত চুরি করে ফুটেছে পলাশ      




বৃষ্টি , নজরুল

নজরুল নজরুল বলে বৃষ্টি নামল ঠিক বারোটায়
প্রসাধন ধুয়ে গেল মেয়েটির , সে এসে দাঁড়াল
কবিতার চা দোকানে , চুল ভিজছে বৃষ্টির ফোঁটায়

এসে সে দেখেছে আজ বৃষ্টিদিন যতিচিহ্নময়
সমস্ত কবিরা দ্বেয ঈর্যা রাগ কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি
যারা ছিল শান্ত মায়া যারা ছিল গভীর অব্যয়

বৃষ্টি তো জানে না মাত্রা , অনর্গল বালকের মত
সে শুধু রচনা করে ঐক্য বাক্য মাণিক্যের ছবি
বিদ্রোহীসরণি আজ সে দেখেছে বরিষাবিক্ষত   

নজরুল নজরুল বলে বৃষ্টি নামল ঠিক বারোটায়
কেউ  বলল সংখ্যালঘু কেউ বলল অনর্গল স্রোত           






অপচয়

তোমার আদর্শ-ফাঁকে তালেগোলে অশ্রু ঢুকে যায়
ঢুকে যায় কালোবর্ণ বালকের করুন আনন ,
বিধবা ঠাকুমা , তাঁর পাকাচুল , বিষণ্ণ উপায় ...

তদুপরি স্ববিরোধও ছিল এক ফরসা রাজকুমার
অভুক্ত গোধূলি-খাওয়া নদী পার এঁটো মহিষেরা
স্রোতধ্বনি ,পাশে ঘন বাতকম্ম , বসন্ত বাহার

এখন সেখানে জ্যোৎস্না , ভাঙা চাঁদ ঝাঁপ দিয়ে নেমে
লম্বা জিভ ফেলে ফেলে অশ্রু খায় , যে অশ্রু পাথর
যে অশ্রু বসত করে বালকের কালোবর্ণ ফ্রেমে

আদর্শ পাহাড় শিলা ,ডানা ভেঙে , টুকরো টুকরো  আজ
চতুর মাতুল জানে ঊড়ে ছিল সেও বহুদূর 


মধ্যমেধা
মধ্যমেধা সাধারণ । সে তবুও বৃষ্টি হলে একা
ছেলেবেলা মনে পড়ে , চাকুরিও ছাড়তে পারে না ।
বাস-বাস , কাটাকুটি ..কুমীর-ডাঙ্গা ,চাইনিজ চেকার

ওঠে রোদ মধ্যবিত্ত । সে তবুও জেদী জানালায় ...
অসংখ্য ব্যাঙ্গমা এসে তাকে বলে –অ-কবি অ-কবি
দেখ না সবুজ মাঠে সুন্দরী গরুরা হেঁটে যায় !

সাধারণ হয়েছে যে লজ্জা নেই , সমস্ত চারপাশ
বেশ্যা হয়ে হেসে যায় ...মেনে নিতে হয় তাকে আজ
পড়ন্ত রোদের দেশ , প্রদোষের আশ্চর্য নিশ্বাস !

এসব বন্দিত্ব তার । মনে আছে তবু বাল্যকালে
একদিন একা একা পড়েছিল পাতার মুকুট ।                                  



মেধা

মেধা কি স্ত্রীলোক ? তবে মননের লিঙ্গ চাই রাণু
নিরাময় ঘুম হয়ে ঘুমিয়েছে বিশাল প্রান্তর
ঘুমের ভিতরে রাস্তা , জনপদ স্থিরচিত্র , স্থানু

প্রকৃতি –পুরুষ হাঁটে , হাওয়া দেয় গাছের শরীরে
ছুঁয়ে দেখি প্রাণ নেই শুধুমাত্র অতীত রয়েছে
কাঠডাঙ্গা – তবু কেউ জল ভাবছে ,নাও আনছে তীরে

কল্পনায় দোষ কই ? বলো রাণু তুমি কোনদিনও
আমার হবে না তবু রোজ রাত্রে  মাঝি হই আমি
চেনো না আমায় ? আহা বহুরূপী , চিনে নিও , চিনো

মেধা কি স্ত্রীলিঙ্গ রাণু ? কতবার মনন মেখেও
তোমাকে পাইনি আমি কানাস্বপ্নে আপেল দেখেছি      




গল্পকার
ঘটনা বানাও , এসো গল্পকার , মিথ্যাবাদী কে কে ?
ঘটনা সাজায় যারা , যারা রোজ মিথ্যা কথা বলে   ,
তারাও অদৃশ্য কালি , ঘটনার পরম্পরা লেখে ! 

এমনই জীবন ,তাই লেখা হল , শব্দে , কলরবে ,
দূরের পাহাড় নীল তৈরি হল লেখার টেবিলে
তৈরি হল মেঘ , হাওয়া , লেখা বলল , ‘ঝড়বৃষ্টি হবে ’

বাস্তব কি সত্য খুব ? সাদা পাতা আসলে কবর , 
বয়স চন্দন শব্দ , মিথ্যেবাদী ধূপকাঠি জ্বেলে
রোজই যে নিজের শ্রাদ্ধমন্ত্র পড়ো রাত্রি দিন ভোর !

সবাই গল্পের লোক , লেখকেরা তবু পুরস্কৃত
অথচ যে মিথ্যাবাদী লোকে তার বদনাম করে !                                         




আত্মপ্রতিকৃতি

হিজড়ের সম্মান নেই । তোমারও কি সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ?
মনে মনে রঙ মাখো , কর্মক্ষেত্রে তালি দিতে হয়
স্ববিরোধী স্বর তুমি  যোনিহীন পুরুষভিখারি ...

বাড়ি ফিরে পা’টি তুলে খাটে বসে ধরিয়েছ বিড়ি
সম্পর্ক , টাউট , বেশ্যা ,দালালের মায়াবি বাজার
সারাদিন হয়ে গেল , মনে মনে বলেছ -ফকিরি

মহালয়া মনে পড়ে ...কখনও মহিষ তুমি , বীরও ... 
কখনও বা ... হাসি পায় , হিজড়ে যে অবস্থানহীন
ছদ্মবেশ নিতে  হয় বিজ্ঞানীর ...কখনও বা কিরো

তালি দিয়ে তালি দিয়ে একদিন দেখেছ হাত মেলে    
বাঁ-তালুর বৃহস্পতি , চলে গেছে মঙ্গলের ঘরে




তোমাকে

জটিলতাহীন আজ বসে আছে আমার ঈশ্বর
নবীন মৃত্যুটি লাল শাড়ি পড়ে বসেছে সকাশে
যেদিকে অর্জুন গাছ , নদীজল ফরসা বালুচর

কথা হয় , মৃত্যুকথা , কীভাবে যে প্রতি প্রাত্যহিক
খেয়ে ফেলে আমাদের আয়ু কুড়ে কুড়ে খায় ,তাই
পৃথিবীর আলো যেন ধীরে ধীরে কমে আসে ঠিক

কখনও তোমার সঙ্গে দেখা হবে মিছিলে , মেলায়
শীত আসে এই ভেবে গ্রীষ্ম আসে বৃষ্টি ঝরে যায়
বয়:ক্রমের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাত্রিবেলা

আমার জীবনে আলো এসো প্রভু চারদিকে আঁধার
নিজের কাছেই আজ অস্পৃশ্য হয়েছি দেখ আমি


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাব...