“আমার ভাষাই আমার দেশ। ভাষাঞ্চল।”
অলোকরঞ্জনবাবুর একটা ইন্টারভিউ
নিয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, আপনার দেশ কোথায়? জানিয়েছিলেন, আমার ভাষাই আমার দেশ।
ভাষাঞ্চল। আমাদের গণচেতনার গভীরে একটা সত্বা আছে। যেটা কারও একার না। শেয়ারড।
সবার। তাই আমার। আর সেটাই বাংলা ভাষা। আমার বাংলা ভাষা।
প্রতিটা দেশের ল্যান্ডস্কেপের মতোই
একটা ল্যাঙ্গুয়েজ স্কেপ আছে। কোনও দেশের ইতিহাস মেরে ফেলতে হলে সবার আগে ভাষা মেরে
ফেলা জরুরি। তাকিয়ে থাকা মানেই দেখা না। ব্রেখট সাহেবই কোথাও লিখেছিলেন। তেমনই কথা
বলে যাওয়াই ভাষা না।
আজ যখন সমস্ত দেখা ও ভাবা স্মার্টফোন
ডিজিটাল, ইন্সাটাগ্রাম গ্রেড যখন ঠিক করে দিচ্ছে অনুভূতির রঙ, সফটওয়্যার বাংলা
ভাষা, যখন সমস্ত ভিশুয়াল খণ্ডিত নেটফ্লিক্স, তখন দেখা কি হবে? কীভাবে দেখবে বছর ৩০
এর আমার প্রজন্ম? যখন, তার যা-কিছু ইথোস, সংকট, আগের প্রজন্ম বুঝতে পারছে না,
অনেকে এ বয়সে আসার আগেই পাগল হয়ে গেছে বা মারা গেছে, এত উইন্ডো খোলা তাদের মাথায়,
তাতে এত ভায়োলেন্স, এত অবিশ্বাস, এত ডিপ্রেশান-সেপারেশন। আমরা যারা আর্বান
বাস্তুচ্যুতর দল, তাদের প্রজন্মের দেখার ভাষা কীভাবে পরের প্রজন্মকে বলে যাব?
গ্রাফিতিতে বা র্যাপে আমার সময়ে
অভদ্রজনের আর্ত চিৎকার ধরা থাকছে। ফ্রেম ভেঙে বেরিয়ে আসছে দুনিয়াজোড়া শরণার্থীরা।
ফ্রান্সের ইয়েলো জ্যাকেট বা ভেনেজুয়েলা বা স্নোডেন বা ব্যংসি বা কানহাইয়া কুমার
তারাই। সেখানে লাল ব্রিগেড বা বইমেলা দেখে খিল্লি ছাড়া কিছুই করা যায় না এখন।
মানুষ ক্লান্ত। উদাসীন। এ সব মর্ত্যের শিশুরা সিরিয়া থেকে উঠে এসে আমাদের যদি
বাচাতে পারে..
বাংলা ভাষাকে যে পলিটিক্যালি হারানো
হয়েছে, তা বেনারসে থাকলে বোঝা যায়। কিছুদিন থেকে ও কাজ করে এটাই মনে হয়েছে। গত
প্রায় ৪০ বছর ধরে বাংলাকে কীভাবে কোনঠাসা করা হয়েছে, তারও ধারণা ভালোই মিলেছে।
ইতিহাসে এমন বিরোধ ছিল না।
বাঙালিটোলার একাধিক সাইনবোর্ড বাংলায়। এমনকি, কোথাও হিন্দি
থাকলেও তা বাংলার সমান সম্মানে রাখা। তার মানে, কেউ বড় বা ছোট ছিল না। একটা সময়ে
এই গ্লোরিফিকেশন করা হয়েছে। এবং তা পলিটিক্যালি।
মনে আছে, মুম্বইতে চোখের বালির
সিনে-প্লে-তে কাজ করছিলাম আমরা। ভাষা হিন্দি। কিন্তু কারও কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না
টেক্সট বুঝতে। এক বয়স্ক অভিনেতা শুধু বুঝতে পারছিলেন না, বাঙালি বাড়ির
মা-দিদিমা-রা এত ঝগড়া করেন কেন? করলেও বারবার কাশী বেনারস চলে যান কেন? বস্তুত,
বারবার "কাশী-বেনারস' চললাম বলে স্টেজ থেকে ঢোকা-বেরনো সামলাতে তারা হকচকিয়ে
যাচ্ছিলেন।
মৃণাল সেন চলে গেলেন। যে ক" টা
লেখা পড়লাম, দেখলাম না কেউ বললেন, তিনি একটা বয়সে এসে কেন ফিল্ম বানানো বন্ধ
করলেন। রমাপদবাবু যেমন আর লিখলেন না। বাঙালি প্রথম জানল, শিল্পেও অবসর হয়। যেমন
সমর সেনও। এবং কেউ এটাও তেমন বললেন না, গার্সিয়া মার্কেজ বা গদার যেমন লোকটার
বন্ধু আবার সন্দীপন বা কমলকুমারও তার প্রিয় লেখক। বাঙালির এই নিখিল জায়গাটা
ক" জন বললেন?
অথচ, লোকটার প্রিয় শহর ছিল কলকাতা।
লোকটা বাংলা ভাষায় ছবি বানিয়েছেন।
আজীবন।
সত্যিই জানিনা আমার প্রজন্মের ভাষা
কি। যারা শহিদ হলেন ৫২ সালে, জানিনা আজ তাদের কেউ মনে রাখবে কি না। ২১ তারিখ আসবে।
মোচ্ছব হবে। চলবে সার্কাস। কিন্তু তার সাথে ভাষার সম্পর্ক কতটুকু? যখন সে ভাষার
সবটাই দখল করেছে এন আর আই রা। যখন সে ভাষায় আর পয়সা নেই বলে সন্তানকে শেখানো হচ্ছে
না সে ভাষা।
ভাষার অস্তিত্ব কোথাও যদি থাকেও তবে
তা আগামীর সাবকালচারে। মূলস্রোত যে ভাষায় কথা বলে, তা আমার ভাষা না। তাই দ্রোহ আর
রাগ ছাড়া আপাতত কিছুই জানানোর নেই এ মুহূর্তে।
No comments:
Post a Comment