শরীয়তপুর সিরিজ
সুমন মল্লিক
উৎসর্গ
শরীয়তপুরের প্রত্যেক মানুষকে
রচনাকাল : অক্টোবর ২০১৮
শরীয়তপুর / ১
মিঠে রোদ আর মিঠে বাতাসে হেঁটে চলেছি
আকাবাঁকা মেঠো পথে ৷ দু’পাশে পুকুর আর
বিল ৷ পুকুরে কচুরীপানা আর হাঁসের সাঁতার ৷
এখানে জীবন বড়ই সহজ ও সুন্দর ৷
মানুষের মুখে অনাবিল হাসি , ভাষায় মিষ্টতা ,
হৃদয়ে আপন করে নেবার সহজাত অভ্যাস ৷
টোটোর দুলুনি , দুপুরের ঘুম , সন্ধ্যার আড্ডা
সবেতেই প্রাণ ফিরে আসছে বুকে ৷ তবে
চারপাশের এতো স্নিগ্ধ সবুজেই আমার
মনোযোগ বেশি ৷ এখানে মোরগের ডাকে
ঘুম ভাঙে , ঘুম আসে নরম জোছনায় ভেজা
হেমন্ত-কুয়াশায় ৷ আমি শৈলশহর থেকে
বহুদূর সোনার এই বাংলায় প্রতিদিন হয়ে উঠছি
মাটির মানুষ ৷
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে অনেকটা ৷ এসময়
নৌকাবিহার পাল তুলে
দিচ্ছে বুকে ৷ ঐ যে
বাঁশের ডগায় বসে আছে মাছরাঙা –
শেষবেলার হেমন্তসূর্যে ও যেন ঈশ্বরের দূত ৷
মাঝি জাল ফেলছে জলে , তার গলার সুর
আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জাদুদিগন্তে ৷
আমি ভুলে গেছি শহুরে কোলাহল , আমি
ভুলে গেছি কংক্রিটের জঙ্গলে কতটা
দমবন্ধ হয়ে উঠেছিল আমার ৷ সব ভুলে
আমি ডুবে রয়েছি সোনালি এই জল-বায়ুতে ৷
আমি ফিরতে চাই না , আমি এভাবেই
নৌকায় শুয়ে-বসে থেকে যেতে চাই প্রাণপ্রিয়
এই গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে ৷
শরীয়তপুর / ৩
উঠোনে ঠাকুরঘরের একপাশে গন্ধরাজ আর
অন্য পাশে শিউলি ফুলের গাছ ৷
হাওয়ায়
ভেসে আসা ওদের গন্ধে আমি বিভোর হই
৷
উঠোন পেরিয়েই ঝকঝকে পুকুর ৷ আমি
দুপুর-নিরালায় পারের শীতল ছায়ায়
বসে
দেখি মাছেদের খেলা ৷ পাটকাঠির আগায়
চাকা লাগিয়ে গাড়ি গাড়ি খেলে
কচিকাঁচারা ৷
মাঝে মধ্যেই কানে ভেসে আসে দোয়েল ও
ফিঙের সুর ৷ বাড়ির তিনটে বিড়াল
দারুণ ভক্ত হয়েছে আমার ৷ যেখানেই
যাই
আমার পিছু নেয় ৷ চারপাশে কত কত গাছ
,
ওরা সবাই এখন বন্ধু আমার ৷ অমোঘ ও
মনোহরা এই শব্দ-বর্ণ-গন্ধের
জাদুকোলাজ
আমার তনমনে নিয়ে আসছে দিব্য
হিন্দোল ৷
কলাগাছ কেটে অপূর্ব কলাবউ বানানো
হলো ,
শাড়ি পড়ানো হলো , কি সুন্দর সুন্দর
নৌকো !
বাড়ির মহিলারা খুব ব্যস্ত – আজ
লক্ষ্মীপুজো ৷
দুপুর-ঘুম থেকে উঠেই হাঁটতে
বেরোলাম...
বিকেল এখানে সূর্যের আবির মেখে
রাঙিয়ে দেয়
সবকিছু ৷ আমি তালগাছে হেলান দিয়ে
দেখি বকের মাছ শিকার ৷ আস্তে আস্তে
সন্ধ্যা নামে আর হাঁসেরা সাঁতার
কেটে ফেরে ৷
শঙ্খের শব্দ শুনে ঘরে ফিরলাম ৷
পুজো প্রায়
শেষ ৷ শুরু হলো কীর্তন ৷ আর ঠিক
তখনই
কানে ভেসে এলো আজানের সুর ৷ কীর্তন
আর
আজানের সুরমন্থন আমার রুহ্ কে
পবিত্র করে তুললো ৷ পবিত্র হয়ে
উঠলো
পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ভেজা এই
পল্লী জনপদ ৷
শরীয়তপুর / ৫
এরকম জোছনারাত আগে কখনও দেখিনি ৷
ঈশ্বর নিজের হাতে তৈরি করেছেন ৷ নিঝুম ,
নরম , নান্দনিক – চোখের ক্লান্তি হরণ করে ,
ছড়িয়ে দেয় সোহাগি জাজিম , আমরা
ঝিলের পারে এসে হাজির হই ৷ বহুদূরে
গুটিকয়েক বাড়ির আলো তারার মতো
টিম টিম করে ৷ কুয়াশায় ধোঁয়া উড়িয়ে
শুরু হয় আড্ডা ৷ দেশ , রাজনীতি , পরিবার ,
সংসার থেকে শুরু করে ক্রিকেট , সমাজ ,
ধর্ম কোন কিছুই বাদ যয় না ৷ চাঁদ উঠে আসে
মাথার ওপর আর আমাদের ঝিল-দিল
ভরে ওঠে চন্দ্রসুরায় ৷ সময় স্তব্ধ হয় ৷ আমরা
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে ফিরে আসি
নিজের মাঝে ৷ ঠিক করি কাল আবার হবে...
খালের দু’ধারে কাশবন আর বিবিধ সবুজ ৷
ডিঙি থেকে নেমে পুকুরপার দিয়ে আসছি ,
দেখি , সুপারি গাছে বাসা বানাচ্ছে বাবুইপাখি ৷
ঘর থেকে ভেসে আসছে উলুধ্বনি ৷ আরেকটু
এগোতেই ধূপের গন্ধ এলো ৷ তালগাছ থেকে
তাল পাড়া হচ্ছে , নীচে আগ্রহীদের জটলা ৷
পাশের পুকুরটায় জল সেঁচে মাছ ধরছে
ছোটবড় সবাই – কত কত মাছ , নাম জানি না
সব ৷ ছোট দাদা বাড়ির পুকুর থেকে জল তুলে
ঢেলে দিচ্ছেন পেঁপে গাছের গোড়ায় ৷ লাউগাছ
মাচার অর্ধেকটার দখল নিয়েছে , ফুলও
এসেছে অনেকগুলো ৷ আমি এসবের মাঝেই
ভীষণ ভালো আছি ৷ সহজ ও সুন্দর এই
যাপন আমাকে করে তুলছে চিরহরিৎ ৷
শরীয়তপুর / ৭
সবুজ বিলভর্তি শাপলা ফুল আর তাতে
মেঘের
প্রতিচ্ছবি ৷ কয়েকটা পানকৌড়ি আপন
তালে
মত্ত ৷ এমন মনোহরা দৃশ্য আমি আগে
কখনও
কোথাও দিখিনি ৷ রাখাল বালক গান
করতে
করতে গরু নিয়ে চলেছে ৷ পুকুরে
ছিপ দিয়ে
মাছ ধরছে দু’জন বয়স্ক মানুষ ৷
আমি হাঁটতে
হাঁটতে একটা বটগাছের ছায়ায় এসে
বসলাম ৷
একটা নরম শীতল বাতাস আমার
ক্লান্তি
মুছে দিল ৷ বাঁশের মাচায় একটু
শুয়ে পড়লাম ৷
ডালে বসে কোকিল ডাকছে ৷ কানে
ভেসে এলো
লালনের মিঠে সুর ৷ কখন যে ঘুমিয়ে
পড়লাম
একদম খেয়াল নেই ৷
দুপুরের ভাতঘুমের অভ্যাসটা এখানে আসার পর
আরও গাঢ় হয়েছে ৷ ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সূর্য
ঢলে পড়ে পশ্চিমে ৷ জানালা দিয়ে অস্তগামী
সূর্যের আভা গায়ে মেখে আমি বেরিয়ে আসি
উঠোনে ৷ নারকেল গাছে অবিরাম ঠুকে যাচ্ছে
একটা কাঠঠোকরা ৷ আমি গোধূলির আলো বরাবর
হেঁটে চললাম দুটো পুকুরের মাঝে নরম ঘাসে ঢাকা
মেঠো পথে ৷ মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে
পুকুর থেকে কাজ সেরে ফিরছে মহিলারা ৷
আরেকটু এগিয়ে পাকা রাস্তায় উঠতেই দেখি ,
মসজিদে নামাজ শুরু হয়েছে ৷ বাজারে পৌঁছুলাম ৷
গালামাল দোকানের ছেলেটা এখন ভালোই চেনে
আমাকে – ‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস’ আর ‘মালব্রো’
আমার প্রিয় হয়ে উঠেছে ৷ সেলুনের ছেলেটির
হাত বেশ ভালো ৷ আমি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে
কিছুক্ষণ মাছ ধরা দেখি ৷ সেখানকার লোকের সাথে
আড্ডা হয় , কথা হয় নানা বিষয়ে ৷
ফিরতি পথে হাঁটা লাগাই ৷ মাসিমা সন্ধ্যাপ্রদীপ
জ্বালছেন তুলসীতলায় ৷ ঘরে টিভি চলছে ৷ বাচ্চা-বড়
সবাই একসাথে বসে এ-ঘরেই ক্রিকেট দেখে আর
খাটের ওপর বসে তাসের আসর ৷ আমি এই
দুই খেলার মাঝে বসে মোবাইলে নিজের কাজ সারি
আর মনে মনে ভাবি , এ-জীবন আমি কোথায় পাবো
কংক্রিট আর যন্ত্রদানবের মাঝে... ৷
শরীয়তপুর / ৯
হেমন্তবাতাসে ভেসে আসছে শিউলি
ফুলের
সুবাস ৷ মায়ের পেছন দলবেঁধে
হেঁটে চলেছে
সাতটা মুরগিছানা ৷ উঠোনের রোদে
চেয়ার পেতে বসেছি খবরের কাগজ
হাতে ৷
একটা বউকথাকও একনাগাড়ে ডেকে
চলেছে ৷
বাচ্চারা খেলছে গোল্লাছুট ৷
কয়েকজন
মুরুব্বি মানুষ পুকুরপারে বসে
বিড়ি খেতে খেতে
আলোচনা করছে আসন্ন ভোটের ৷
আজ পদ্মার ইলিশ এসেছে বাড়িতে ৷
পাশের
নদী থেকে পুঁটি মাছ ধরে দিয়ে
গেছে
গাঁয়ের ছেলেরা ৷ পালং আর কলমি
শাকও
রান্না হচ্ছে ৷ মাসিমা তেলে ঝালে
অপূর্ব রাঁধেন ৷
এখানকার অনাড়ম্বর ভোজনেও আমি
অদ্ভুত
আড়ম্বর খুঁজে পাই, মনে বেঁধে
রাখি...
শরীয়তপুর / ১০
ঝিল পেরিয়ে ওপারে গেলাম আজ ৷ ডালিমগাছে
কি সুন্দর ফুল ফুটে আছে ৷ দুটো রাজহাঁস
জলকেলি করছে পুকুরে ৷ আলে বসে পেঁয়াজ আর
কাঁচা লংকা দিয়ে পান্তাভাত খাচ্ছে দু’জন কৃষক ৷
এই প্রথম তিতির দেখলাম ৷ একদল ছেলে মেয়ে
লাট্টু খেলছে সোল্লাসে ৷ মাচায় বসে আয়ুব বাচ্চুর
গান শুনছে তিনজন মাঝবয়সী লোক ৷ আমি স্থির
দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম ৷ জেলের জালে দেখি
মাছ ধরা পড়েছে – শোল, মৃগেল,আমেরিকান রুই
আর বেশ কিছু পুঁটি ও ছোট ছোট মাছ ৷ জেলেবউ
আমাকে দেখেই ঘোমটা টেনে নিলো ৷ জেলেভাই
আমার পরিচয় জানতে পেরে সানন্দে গল্প জুড়ে
দিলো – মাছ ধরার নানান মজাদার কিস্সা ৷ স্কুলফেরত
মেয়েরা আমড়া খেতে খেতে, গল্প করতে করতে
বাড়ি ফিরছে ৷ আমার সঙ্গী শ্যাম দা ৷ আমরা ঝালমুড়ি
খেতে খেতে আরেকটু এগিয়ে গেলাম ৷
একটা ছোট্ট গ্রাম – স্বপ্নের মতো, স্বর্গের মতো
সুন্দর, মায়াময় ৷ আমরা একটা বাড়িতে জল চাইলাম ৷
জলের সাথে নাড়ু মুড়িও এলো ৷ ইন্ডিয়া থেকে এসেছি
জেনে অনেকেই দেখতে এলো ৷ কেউ কেউ দুপুরে
খাওয়ার দাওয়াতও দিলো ৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম ৷
একজন অপরিচিত মানুষের জন্য এতো আন্তরিকতা,
এরকম আতিথেয়তা !
মনে মনে বললাম –
এ কেবল সোনার বাংলাতেই সম্ভব ৷
শরীয়তপুর / ১১
সকাল থেকে বৃষ্টি চলছে একটানা ৷ হিম-বাতাস
আরও অলস করে তুলেছে আমাকে ৷ জানালা
দিয়ে দেখছি পুকুরের জলে বৃষ্টির আল্পনা ৷
খেজুল গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ছে
টিনের চালায় ৷ আমগাছের যে ডালটা
পুকুরের দিকে নীচে নেমে গেছে , তাতে উঠে
ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে স্নান করছে তিনটে ছেলে ৷
থেমে থেমে মেঘের গর্জন ৷ দুটো শালিক
ঠাকুরঘরের টিনের নীচে বসে আছে পাশাপাশি ৷
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে টের পাচ্ছি
আমার ভেতরেও এক বৃষ্টি গতি বাড়াচ্ছে –
আর তো একদিন , তারপর বিদায় নিতে হবে
এই পল্লীবাংলা , এই প্রিয় সোনার বাংলা থেকে ৷
শরীয়তপুর / ১২
সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল ৷ বৃষ্টি নেই ৷
মেঘ আর সূর্যের অদলবদল ৷ ব্রাশ করতে করতে
ভেজা ঘাসের ওপর খালি পায়ে কিছুটা
পায়চারি করতে বেরোলাম ৷ সমস্ত সবুজ যেন
আজ গলে নেমে আসছে আমার ওপর ৷
পুকুর , খাল, বিল, ঝিল থেকে অজস্র হাত
টেনে ধরছে আমাকে ৷ পাখিদের গলাতেও
যেন বিরহসুর ৷ দুপুরের পর আমি গৃহবন্দী
করে ফেললাম নিজেকে ৷ কাল চলে যাব ,
কিন্তু আমার হৃদয় পড়ে থাকবে শরীয়তপুরে ৷
এখানকার প্রাণবায়ু আর একমুঠো জল সযত্নে রাখলাম
দু’হাতে ; বাড়ি ফিরে মিশিয়ে দেবো বৈকুণ্ঠপুর আর সাহুতে ৷
No comments:
Post a Comment