Tuesday, February 19, 2019

আল মাহমুদের স্মরণে হিন্দোল ভট্টাচার্য





      বাংলা কবিতার ব্যক্তিত্বের নাম আল মাহমুদ



সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যাবসা শিখিনি
দেহ দিলে দেহ পাবে দেহের অধিক মূলধন
আমারতো নেই শখি, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরষ আবৃত করে জলপাই পাতাও থাকবেনা,
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরষ্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা- উপশিরা।
এ -তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেল সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ মাটির গায়।
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবেকি হে বন্য বালিকা
অভাবের অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মত এঁকে দেব হিঙুলের টিকা।

সোনালী কাবিনের এ হেন প্রথম কবিতা বাংলা কবিতার জগতে যেন এক স্পর্ধিত ঘুরে দাঁড়ানোর ছবি এঁকে দিল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তরে-তে তিনি দেখেছিলেন শিশু ও পশুর বিরোধ। এই বিরোধ তাঁর আজীবনের কাব্যকৃতির এক সম্পদ বলা যেতে পারে। এই বিরোধ নাগরিক আল মাহমুদের সঙ্গে তিতাস-পারের আল মাহমুদের, কবিতার স্বধর্মে বিশ্বাসী আল মাহমুদের সঙ্গে ধার্মিক আল মাহমুদের এবং সর্বোপরি ছিন্নমূল আধুনিকতায় বিশ্বাসী আল মাহমুদের সঙ্গে শিকড়-সন্ধানী আল মাহমুদের। বিনয় যাকে বলেন ‘ বিকাশের রাজনীতি এই’, তাকেই তিনি অন্য ভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন। আজীবন এক দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে তাঁর কাব্যজীবন। সোনালী কাবিনের মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। অথচ সোনালী কাবিনের মধ্যে মহাকাব্যিক অভিযাত্রাও স্পষ্ট। যে যে বিষয়গুলিকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ মহাকবিতার কথা বলেছেন তাঁর কবিতার কথায়, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন সেই বিষয়গুলিকে ধারণ করে থাকে। এই যে ইতিহাসের এক ভিন্ন আবিষ্কারের মধ্যে তিনি প্রবেশ করেছেন, ছোট ছোট অসংখ্য প্রতীকী বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেই সেইগুলিকে জন্ম দিয়েছেন তাঁর কবিতায়। আল মাহমুদের কবিতার অন্যতম বিস্ময়ের দিক এখানেই বলে আমার অন্তত মনে হয়। একদিকে যেমন তিনি খনন করছেন, অন্যদিকে তেমন তিনি খনন করে যা যা পাচ্ছেন সেগুলিকে জন্মও দিচ্ছেন। তৈরি হচ্ছে এক অনবদ্য নতুন ভাষাপ্রবাহ। তিনি নিজে একটি গদ্যে লিখছেন- ‘জাগতিক সব সৌন্দর্যবোধই শেষপর্যন্ত ক্লান্তিকর, যেমন নদীর সাথে নারীর তুলনা… এখন আর প্রাণের সাথে প্রকৃতির তুলনা আমাকে তৃপ্তি দেয় না, বরং ছেলেখেলা মনে হয়… পবিত্র কোরান পাঠ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে আমার অতীতের সর্বপ্রকার ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধকেই পালটে দেয়।’ কিন্তু এই আধ্যাত্মিকতা তো পরের দিকের। মনে হয় পরবর্তীকালের আল মাহমুদের আধ্যাত্মিকতা বরং অনেক বেশি অনুশাসিত, ইংরেজিতে যাকে বলে স্ট্রাকচারড। কিন্তু লোক লোকান্তরে, কালের কলস, সোনালী কাবিন, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাঘর যত পড়ি, তত মনে হয় প্রথম থেকেই তাঁর এক বিশ্বজনীন সংযোগ ছিল, যে সংযোগকেই মূলত বলা যেতে পারে আধ্যাত্মিকতা। এই সংযোগ একজন কবিকে চিরকালীন এক মহৎ কবিতার দিকে নিয়ে যায়। প্রত্যেক কবিই হয়ত আজীবন এই মহৎ কবিতা লেখার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু সময়ের মতো সৃজনশীলতাও নয় একরৈখিক, যে একজন অভিজ্ঞতা লাভ করবেন, তবে তিনি সত্যের সঙ্গে সংযোগ করতে পারবেন। বরং এই সংযোগ অনেক ক্ষেত্রেই আসে অপ্রত্যাশিত ভাবে। এই যে মিথের দুনিয়া তিনি খুঁড়ে বের করেছেন বারবার তাঁর কবিতায়, এই যে টোটেম- লোকায়ত সংস্কৃতি- সৌন্দর্যবোধ আর ইতিহাসচেতনার জগতে তিনি অবগাহন করেছেন, তা তো একপ্রকার সেই অপ্রত্যাশিতকে পাওয়ার জন্যই। এই অপ্রত্যাশিত যেমন ঈশ্বর হতে পারেন, তেমন নাও হতে পারেন। ঈশ্বর হলেন কি হলেন না, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই সংযোগ হল কিনা! কারণ সংযোগ একপ্রকার ধর্মহীন, অনুশাসনহীন অপ্রত্যাশিত স্পর্শ, যা আল মাহমুদের কবিতায় দেবদূতের মতো আসে যায়।

আঞ্চলিক ইতিহাস, আঞ্চলিকতার রঙ, স্পর্শ গন্ধ জীবনানন্দের চেয়েও আরও নিখুঁতভাবে তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ‘লোকাল’ হলেও তাঁর কবিতায় কি এই ‘গ্লোবাল’ প্রেক্ষিত ছিল না? তিনি ব্যবহার করেছেন আঞ্চলিক শব্দ, আঞ্চলিক প্রতীকের সংসারকে। কথা বলেছেন সেই সংসারের, ইতিহাসের। কিন্তু তার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকতাকেও স্পর্শ করে আছেন। এই স্পর্শ করে থাকা কিন্তু নির্মিতি, সচেতন নির্মিতি। কিন্তু তার গঠন এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত, যে বোঝা যায় কবির রাজনৈতিক অভিপ্রায়ও। যেমন একটি সনেটে তিনি লিখছেন-

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েন সাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম শান্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণির উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ,
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ

তাঁর জীবনের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এর অন্বেষণও তিনি করে গেছেন আজীবন। গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের স্রোত এসে যে একদিন শহর দখল করে নেবে, এ কথা তিনি ভেবেছেন। সে কথাও তো সোনালী কাবিনের কবিতাগুলিতেই স্পষ্ট। অনেক সময় তো কবিকে সব কথা উচ্চারণ করে প্রত্যক্ষ ভাবে বলতে হয় না। এভাবে বলার প্রয়োজনীয়তাও হয়তো অনেক সময় থাকে না। যেমন সোনালী কাবিনে ইঙ্গিতময় কাব্যের এক চূড়ান্ত অভিসার রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রত্যক্ষ ঘোষণার কবিতাও। সবথেকে বড় কথা সোনালী কাবিন একটি অনিবার্য কাব্যগ্রন্থ বলে মনে হয়। এমন একটি কাব্যগ্রন্থ্, যা হয়ত লেখার স্বপ্ন অনেক কবির থাকে আজীবনকাল।

বাংলা কবিতায় শুধু না, বিশ্ব কবিতার মানচিত্রে আল মাহমুদ এক চিরকালীন সাধনার নাম। নশ্বরতার ক্ষণস্থায়ীত্ব যাকে স্পর্শ করতে পারে না। 

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাব...