##
জাংকইয়ার্ড ## ১
আমি আজকাল লাশ হয়ে গেছি। চলে ফিরে
বেড়ানো লাশ। পাঁচ ফুট সাড়ে সাতের মোটাসোটা, আই টি দেওয়া, ক্রিম মাখা, ঠান্ডা নধর
লাশ। লাশ বাজার করে, দাড়ি কাটে, ক্লাশ নেয়। কথা বলে অন্য লাশেদের সঙ্গে। খুনসুটি।
মস্করা। একটু আধটু রাগারাগি, অভিমান। পিঁপড়ে কামড়ে দিলে পেছনে লাল হয় এখনো। হাত বুলিয়ে
নেয়। চুলকোয়। শ্রীপঞ্চমীর সাতসকালে স্নান সেরে মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকায় চোখ রাখে
নিয়মিত। গা এলিয়ে বসে থাকে সজল দুপুরে।
এখন আমি লাশ হয়ে থাকতেই অভ্যস্ত। সাত
চড়ে রা কাড়ি না। মানিয়ে গুছিয়ে চলতে পারি নিপাট ভালো লাশের মত। রাজনীতি করিনা। যা
করি, তাকে নিজেদের মত করে ছেনে, ঘেঁটে, মন্ড পাকিয়ে হাতের মুঠোতে আদল দিয়ে নেয়
পাড়ার দাদারা। ওদের মনের মত করে বানিয়ে নিতে পারে বলে আমি ওদের প্রিয় লাশ। আমি
বদলে যাই। ওরা কদর করে। অন্যরকম হয়ে যাই। নাম সম্মান জোটে। নিজেকে দেখে আর নিজেই
তেমন চিনতে পারিনা। খুব অসুবিধে হলে পাশ ফিরে ঘুমোই। চোখের ওপর তোয়ালে টেনে দিই
সাদা টার্কিশের।
আমি আজকাল সত্যিই লাশ হয়ে গেছি।
রাস্তায় বেড়োলে লোকে এখন, ও লাশ দাদা, বলেই ডাকে। এই যে শুনছেন, লাশকাকু; অথবা,
এই, লাশ, কেমন আছিস, কতদিন দেখিনি, বল তো। আমি উত্তর করি। হেসে হাত মেলাই অন্য
লাশেদের সাথে। অনেক লাশ মিলে জানুয়ারি মাসে পিকনিকে যাই। নাচি, গাই, ফুর্তি করি।
পাঁজরের ঠান্ডায় আগলে রাখি একে অন্যকে। আমি এসবে এখন আর তেমন অবাক হই না। আর
তাছাড়া, চারপাশে অবাক হওয়ার মতো তেমন কিছু নেইও এসময়।
শুধু মাঝে মধ্যে, রাতে বা দিনে, আবছা
আলোয় কিছু মানুষের হালকা ছায়া এখনও দেখতে পাই ইতি উতি। তখন, একমাত্র তখনই, ভীষন,
ভীষন ভয় করে আমার। কিছুতেই স্বস্তিতে থাকতে পারিনা। ঠোঁট, গলা কেমন যেন শুকিয়ে কাঠ
হয়ে যায়। হাত, পা সব ভারী হয়ে আসে। শীতেও ঘামতে থাকি দেদার। রাতে হিসি পেলে বাইরে
যেতে ভয় করে। মনে হয় বাবাকে ডেকে বলি, দাঁড়াতে। আচমকা মানুষ দেখলে, মাইরি বলছি,
বীভৎস বুক কেঁপে ওঠে ইদানিং।
##
জাংকইয়ার্ড ## ২
উঁচু জাত হলে রোগভোগ নিয়ে ভাবা যায়।
এমনকি মৃত্যু নিয়েও। দুশ্চিন্তা হয়। অসুখের কষ্ট। ডাক্তারের বিল। হাভাতে পেট। ঠোঁট
চেপে মানিয়ে নিতে হয় নিঃসীম প্রিয়-বিয়োগ। শোওয়ার ঘরে শূণ্য হয়ে যাওয়া বিছানা তোষক
লেপ। কলসী ভেঙ্গে ঘরে ফেরা। মন খারাপের আঙুলে আঙুল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দমচাপা
কান্না। ছোট ছোট দু-একটা বিষন্ন হাঁড়ি ও কড়াই। কয়েকটা নিরুপায় হাজিরা কমে যাওয়া
একশো দিনের কাজ। ভাগ করে ফ্যান খাওয়ার হঠাৎ কমে যাওয়া অভ্যস্ত সুখ। এরপর কিছুদিন
পৃথিবীকে ক্লান্তিকর ভারী মনে হতে থাকে।
কিন্তু জাত নীচু হলে রোগ শোকের পরেও
কিছু চিন্তা জেগে থাকে উপোসী আঠার মত। মরে যাওয়া শরীরে বাঁধন দিতে দিতে মেপে নিতে
হয় সাইকেলের পাম্প, দড়ির গিঁট অথবা কাঁধের জোর। সকাল সকাল হাভাতে পেটে গামছা বেঁধে
মুছে নিতে হয় কপালের ঘাম। লম্বা পথ। গড়ানো বিকেল। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সারি সারি
ভ্যান, রিকশা আর টেম্পোর ধুলো থেকে ঢেকে নিতে হয় নিজের এবং মৃতশরীরের উদাসীন মুখ।
ক্যামেরায় বাইট দিতে শেখেনি বলে হতভম্ব মৃত্যু ভাগশেষ হয়ে রয়ে যায় সমস্ত মিলে
যাওয়া অঙ্কের পাতায়। অজান্তে ভাইরাল হয় বিশ্বের দীর্ঘতম অগস্ত্য যাত্রা। অফুরান
গ্লোব ট্রটিং অথবা ট্রোফিহীন স্লো সাইকেল রেস।
মৃতের জাত নীচু হলে রাজনীতির গাঢ়
মাসকারা হালকা হয়ে আসে। পথচলতি শবদেহ ভারী হয়, হতেই থাকে, স্ত্রী, স্বামী,
সন্তানের কোলে, কাঁধে, সাইকেলে।
##
জাংকইয়ার্ড ## ৩
যেসব পথে না গেলে হাততালি জোটেনা,
সেসব পথে, মোড়ে, মোড়ের মাথায় আলগোছে রাখা থাকে একটা উন্মন, দু-একটা উশখুস। বাহারি
কথার মত থাক থাক গুছিয়ে রাখা শাড়ি। জামাকাপড়। যাকে পড়তে চাই, অথচ বুঝতে চাই না,
এমন সব দুরূহ তত্ত্বভার। সেখানে হালকা সুতির আঁচল গায়ে রোগাসোগা বসে থাকে সংসারি
ধর্মও। নকুলদানা, বাতাসা বা ভেজা তুলসী। সার বেঁধে বয়ে যায় পিঁপড়ের মতামত। গলে
যাওয়া চিনির ডেলা থেকে নারায়ণের পা ইস্তক। মুহুর্তে গড়িয়ে পড়ে সুজাতার নবান্ন
পায়স। ঠোঁটের কষে। উদাসীন করতলের মাধুকরী মুদ্রায়। ভাষায়, নির্বাণে। যেদিন ধানের
বুকে জমেছে দুধ, অথবা লাশ নিয়ে নগরোপান্তে চলে গেছে একলা শবর, সেইসব দিনে লেখা
থাকে কল্যাণমুদ্রা। বরাভয় আঁকা থাকে বাসরঘরে। দেওয়ালে দেওয়ালে। বেলপাতা আর ঝিনুকের
মুগ্ধ সহচরে। আট কুঠুরি, নয় দরজা কাফনের শান্তি খুঁজে নেয়। সাদা জ্যোৎস্নার শাল
মুড়ি দিয়ে। যেভাবেই চর্যা বলোনা কেন, অস্ফুটে বা আড়ম্বরে, ধর্মকথা লেখা থাকে আচারে
বিচারে।
একে একে লেখা হয় পারম্পরিক সামগান।
বানপ্রস্থ অবধি সামাজিক যৌথ জীবন। লেখা হয় শ্রাদ্ধ, শান্তি, স্বস্ত্যয়ন। বহু নারী
থেকে এক নারী যাপন। কর্তব্য, কারাবাস। লেখা হয় বিভেদরেখা। উঁচু ও নীচু সব কুয়োতলার
করুণ জললিপি। লিখেছি শ্রেণী, নাম, গোত্র ভেদাভেদ। লিখেছি কর গোনা সুখের পাশে
অগুন্তি না-খাওয়া। এইবেলা লিখে রাখি সঙ্গীত, মেহেন্দী। উদ্ধত, অপচয়ী আপ্যায়ন লিপি।
মেঘের থেকেও উঁচু কোনো ঠান্ডা, নিঃসঙ্গ কপালে বিব্রত বলিরেখা। অতঃপর লিখে রাখি
চাষীদের হাঁটা। পৃথিবীর বুকে। কতখানি ক্ষিদে পেলে সহায়ক মেলে না কোনো বনলতা পরশ,
সে বার্তা লেখা হয় উপোসী পাতে। নার্সিসাসে বিভোর হয়ে লিখে ফেলি, 'আমি'। অন্তর্যামী
জানেন, তারই পাশে ফুটে ওঠে অদৃশ্য সর্বনাম। একটুকরো, 'তুমি'। শ্রমণ ও রমণ লিখি
পাশাপাশি। সংসারী বাউলের সুরে।
এসবই লিখন অভ্যেস গুহাকাল থেকে ভুবনের
পোষাকী হাটে। আঙিনায়। এসবই শিউরে ওঠা মাৎসন্যায় দুঃখে ও সুখে। তীর ধরে হেঁটে গেলে
পরে, ভেজা বালি পড়বেই পায়ে। এমনই সাজানো ছিলো, থাকে, আশ্চর্য কুরুক্ষেত্র। জীবিত ও
মৃতের অমোঘ বয়ানে সাধারণ দিনমানলিপি।
তুমি একে লড়াই বলতে পারো। এথিক্যাল
বাঁচা/মরা খেলা। আমি একে ওতপ্রোত বলি। ইতিহাস বুঝে নেওয়া প্রাজ্ঞ উইঢিপি।
##
জাংকইয়ার্ড ## ৪
ধরো, লিখলে ফুল। লিখলে ফুলের পরাগ।
নিষেকডাঁটি অথবা পাপড়ির অসংখ্য রঙ। আবার একটু পালটিয়ে লিখলে, ভাষা। বোঝা না-বোঝার
জমাট বাঁধা স্পেস। শব্দ সম্ভাবনা। লিখলে ঈষৎ তির্যক দুলে ওঠা বা ভীষন আঁকাবাঁকা
কোনো বাক্যের নিঃসীম ছায়াপথ। সুদূর নীল আলো। দুধ সাদা বিস্ফার আর নিকষ যা যা হয়।
কিছুটা মানুষও লিখতে পারো। অল্প। পথ্যসহ এক বা দু চামচ সতর্ক মানুষলিখন। তাদের
বসতে কারিকুরি। বমনে কৃৎকৌশল। বেঁচে থেকে মরে যাওয়ায় অনন্তের হাতছানি। নিশ্বাসের
যতিচিহ্নে সম্পর্কের টানাপোড়েন। ইতিউতি ফিসফাসও নাহয় সলজ্জ লিখলে একদুটো। অক্ষর
চিহ্নে। চোখেমুখে জল দিয়ে মাল্লু মামণিকথা। এরপরই আঁটো স্বরে লিখে ফেলতে পারো
বেড়ালের প্রেম পিরীতি। নাইহিলিস্ট এনামেলে। বরসানা গ্রাম আর তুলসির বন। অনুভূম,
গ্রোটেস্ক ইমেজে।
এসবই লিখলে তুমি। আর ধীরে ধীরে ঘরের
কোণে জমে উঠলো আঠালো পান্ডুলিপি। ঘুম চোখে। আড়মোড়ায়। অলস রেডব্রেস্টের উদগ্রীব
বুকের মত। তখন রাতের আকাশে শোনা যাবে সস্নেহ কোলাহল আর দিনমান ভরে যাবে মাংসল
প্রণয়চিহ্নে। বুড়ো আঙুলের খেলায় তখন মাতোয়ারা চারপ্রহরের পুকুরপাড়। ঘুঁটের দেওয়াল।
খুশি খুশি তোমার মনে অক্টোপ্যাডের নিমাইসন্ন্যাস।
শুধু, ভুল করেও প্রসংগ লিখোনা। লিখোনা
মানুষের শিরশিরে উঁচু ও খাদ। বিপজ্জনক হারতে না চাওয়া। শ্বাসের ইতিহাস। নিরন্ন,
নিরঅহং। সময় লিখোনা। আড় ভেঙে লিখোনা কিছুই। যে পৃথিবী পায়ে নিয়ে চুল্লিতে আগুন,
তার তাপ লিখে রেখোনা কোথাও। সেই তাপে সেঁকবে না একটিও রুটি। তাহলেই তুমি বিষাক্ত
হেমলক।
বেরসিক স্ক্যোয়ার ফুটে অবাধ্য
ভ্রুকুটি।
##
জাংকইয়ার্ড ## ৫
প্রেম সম্পর্কে আমার একটা জরুরী অভিমত
আছে। পোড়া দেহ। অসহায়। একাকী। কি দিয়ে জুড়াই, জানি না। সে কথা বলছি। তবে আগে বলে
নিই, এখনো পর্যন্ত গুমখুন হয়ে যাওয়া সমস্ত লাশের হদিশ পাওয়া যায়নি। ধরো, যারা
ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলো, আর একমনে ভেবেছিলো খিদে, মাটি কিংবা সন্তানের মুখ, তাদের
নামগুলো সব ভেসেছিলো পুকুরের জলে। এমনই ভুলোমন সব, ঘরে ফেরা হলো না বলে খবরেও
শোকের গত্তি লাগলো না। বাঁশ অথবা কাটারিতে ঝরেছে যে রক্ত, তার দায় নিচ্ছেনা কোনো
পক্ষই। তবুও, সাইরেন বেজে যায় বোবা পথঘাটে। আবারও আসন্ন হয় মাশান পরব।
প্রেম নিয়ে অন্তত একটি বিষয়ে আমি
নিশ্চিত খুবই। বলছি সে সব। তবে আগে বলতেই হবে, ভীষন বাড়তি এখন গৃহ অন্ন সুখ। যা
আছে, দু'বেলা তার রস হয়ে পচে যাওয়া অবর বিধান। ইহাতে সমন জারি করা। উহাতে নিভৃতে
আচমন। যা দিনকাল, তাতে করে কি চাইছো, অথবা চাইছো না, সেসব পরিষ্কার নয়। আর কাজটাজ
করাও একধরনের বোকামো। এই যদি বুঝলে পদোন্নতি, তবে তার পাশ দিয়ে আলসেতে গলে যায় এক
ঘর চরমভাবাপন্ন। আলতো ক্যাকোফোনে। ঝাঁকে ঝাঁকে লোভ ঠিকরে আসে হাত বেয়ে। হয়তো খায়নি
অনেকদিন। পেটপুরে। গালভরা লেগে ছিলো নির্জলা এঁটো। তাও সে নয় নয় করে প্রায় গোটা
শীতকাল। খিদে ছিলো। ছিলো, দিন রাত এক করে আশঙ্কায় দীর্ণ, নিঃস্ব হওয়া। পিত্ত, পা,
প্রহর থেকে পেট ইস্তক। লম্বা, সরু, লিকলিকে শ্বাসভার গাঢ় ছিলো নিরূপায় বেঁচে বর্তে
থাকার মধ্যে। মৃত্যুর অমোঘে ভর করে। জন্মাবধি জাহান্নামে। প্রাণ লেখা ছিলো। থাকে।
দেশীয় জরার হাড় মাস কালির কাঠামোয়। প্রত্যেক পঞ্চবার্ষিকী আত্মপ্রবঞ্চনায়। চড়া
রোদে হেঁটে যাওয়া ইল্লুতে ইশারায়। একেই বোধহয় মায়া বলে ডেকেছিলে পুরাতন ওষ্ঠে
গতকাল।
প্রেম সম্পর্কিত কিছু উচাটন কমবেশি
সকলেরই থাকে। সুতরাং, আমারও আছে সেসব। দীঘল স্রোতের পাশে আবক্ষ ভাসমান। সেকথাই
বলবো। তবে সময় থাকতে বলে নিই প্রগতির স্বার্থবাহী বসতি উচ্ছেদ। বলি, গাছ। আর, তার
ঠিক পরে, বলে রাখি পথ মাঠ ধুলোয় ভরানো পলাতক কুয়াশা লিখন। যে বালিতে হেঁটে গেলে
মুছে যায় পদচিহ্ন, সর্বাগ্রে এঁকে রাখি তার পান্থনাম। বৃক্ষ যদিও ছিলো, বোধ ছিলো
না কখনোই। যে কারণে ঘরে ওঠেনি বোধিসত্ত্ব দান। আজ বলছি, মহামানবের অষ্টোত্তর নাম।
জড়তায় স্পষ্ট হচ্ছে অনভ্যাসের চন্দন। চড়চড়ে। দানা দানা। অচর্চিত কপালশোভা। বদলে
দিচ্ছি গল্প। বদলে দিচ্ছি স্থান কাল পাত্র। কল্পান্তের মানবশৃঙ্খল । পরক্ষণে বদলে
নিচ্ছি ভূমিকা। পাত পেড়ে বসে পড়ছি শ্রোতার পিঁড়িতে। উৎসুক, উদাসীন। বিড়ম্বনায় পড়ে
নিচ্ছি অপাঠ্য অজাচার।
ইতিহাসে কোনোদিন গ্রন্থিত ছিলো কি না
দেশ, অথবা গ্রন্থেই বিবৃত ইতিহাসকথা, সে খেলাতে মজেছেন গোঁসাই। দেশ ঘোরা, বিদেশ
ঘোরা নাগর পর্যটক। কাহিনীকে বিবশ রেখেছি ঠায় সাংখ্যেয় চৌকাঠে। ভুলে যাচ্ছি ঐশ্বরিক
হলেও সমূহ পতন এড়াতে পারেনা উড়ন্ত নামাবলী। এ দিশায় চেতন থাকলেও চৈতন্যে কেবলই
অদর্শন। সে গূঢ় কথা লেখা ছিলো সমুদ্রবিদ্যায়। হাতের রেখায় পড়োনি কি তার কোনো নিটোল
সমাচার? পড়োনি, আঙুলে, স্মৃতিতে, শ্রবণে?
প্রেম প্রসঙ্গে এখনও বলার বাকি আছে।
সেকথা কইবো নিশ্চিত বেতস পল্লবে। নীল কোনো বিষণ্ণ ফলভারে। একলা সমাদরে। তবে এইবেলা
বলে নিই নট-কেত্তন। দিনান্তে পথ দেখে যে সুরম স্বজন, তার কানে লেগে থাকে ঢেউ।
খাবারের। নিতান্ত ছোট্ট, কোনো সজল সুখের। অথবা খুদ-কুঁড়োর অনতি ঈশ্বরের। তার ঠোঁটে
অভুক্তের উদ্বৃত্ত পাচনরস। অব্যবহারে হেলায় হারানো। কপালে গুঁড়ি গুঁড়ি অশান্তির
চিনি। ধর্মনামে আঁতিপাঁতি অকারণ। মধুবিষাক্ত। কে খাবে পলান্ন ভোগ, আর কেই বা একবেলা
অজানা তাম্বুল, অস্বস্তির চতুষ্পদ মাংসাদি, সেসবই বুঝে নেব আমরা। আমাদের চাউনি পথে
দেহলীর প্রতিটি টিলা মাপা থাকে। সর্বদ্রষ্ট দন্ডপথে ধরা থাকে ধর্ষণের আমূল
কার্টোগ্রাফি। ওই যে আলপথে পড়ে থাকা নিথর প্রতিমা, দেশ নামে ডেকেছিলে যাকে, তার
লাশ কাঁধে নিয়ে আমরা হরিশচন্দ্র। আমাদের পশ্চিমে অসময়ে উড়ে গেছে সেনানীর প্রাণ।
পূব দিক বরাবর কয়লা কালো জল। ভেজা ঘনত্বে আটকে থাকা দমবন্ধ লাশ। দেশ নামে মানুষ
বুঝিনি কোনোদিন বলে, যূপকাষ্ঠে পরিয়েছি স্নেহ ও সিঁদুর। হাতে বেড়ি। পায়ে বেড়ি।
মস্তিষ্কে অসহায় কার্বন খুঁড়ে চলা। আজ যাকে চিনেছিলাম ভোরের আলোয়, কাল তার অকাল
বৈধব্যে আমি শ্মশানসখা। চীঁড়ে আর দইয়ে মেখে লিখে রাখি নাগরিক পঞ্জী। আদা বা নুন
দিয়ে এবম্বিধ ভোজ। সমবেত নির্লজ্জ উল্লাসে। আজ, এই এগিয়ে যাওয়া প্রাকৃত পৃথিবীর
আদিম দেওয়ালে। বৃক্ষহীন, মানুষহীন, ইতিহাসহীন স্বদেশপ্রান্তরে।
প্রেম সম্পর্কিত আমার নৈপুণ্য আখ্যান
এইবেলা বলে ফেললেই ভালো হতো। তবু নিরুপায়, দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখি আলতা মাখা পা।
জোড়কলমে। সাদা খাতার নিরব শয্যায়। সঙ্গে দিই দু'কুচি জুঁই। বেলফুলের সুগন্ধী মালা।
শয্যাপ্রান্তে সারিবদ্ধ সাজিয়ে রাখি নিরব লহমা। সজল স্বদেশ আর রাষ্ট্রীয় রোবটিকস।
প্রেম, আমার দিব্যি, আমি জানাবো ঠিকই। দূর কোনো মেঘের গায়ে বসতের আবছা ম্যাপ ফুটে
ওঠায় আপাতত ভালোবাসা আবেশে অধীর। চোখের পাতায় জল থাকলে দৃষ্টিতে সুর কেটে যায়।
চোখে ভাসে আবছা সর। মেঘ থেকে নেমে আসা পরম দেবদূত অদৃশ্য থেকে যান বিভ্রম পরপারে।
সেইকথা মনে করে মুছে নিই অশ্রু। ন্যারেটিভ গুণে নেয় বৃষ্টি ধারাপাত, উশখুশে আগুন
আর শব্দহীন হেঁটে যাওয়া ভারী জানাজা। মাঠে, ফসলে, খাদানে, রাস্তায়। শ্রমিকের,
কৃষকের, সেনানীর, আর্তের। প্রশ্নবহুল সহনাগরের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে। আমার ভেতর অনেক
স্বরের দেশ, মাঠ, চরাচর জেগে ওঠে। উঠতেই থাকে। কান্নায়, ক্রোধে, ক্লান্তিতে,
ক্ষমায়। যে ভাষায় তুমি কথা বলো, সে ভাষায়। যে ভাষায় বলোনি কোনোদিন, সে ভাষাতেও।
প্রেম আমি টুকটুকে সাজাবোই একদিন।
শুধু, দেশ আমাদের আজো কোনো মাতৃভাষা দেয় নি বলে, নিঃসাড়ে বয়ে গেলো ভালোবাসা কথা।
ম্যাকগাফিনের কোল বেয়ে। আলতো লবণে। রাষ্ট্রীয় রেডারে তার অকারণ আসা যাওয়া ছায়াপাত
করেনি কখনো। এমনকি অজান্তেও।
##
জাংকইয়ার্ড ## ৬
এইমাত্র আমি যে লেখাটা লিখবো বলে ঠিক
করেছিলাম, সেটা শেষ পর্যন্ত লিখে উঠতে পারিনি। এরকম মেপে শেষ করে দেওয়া লেখা আমার
একটিও নেই। কারণ লেখার চেষ্টাটাই আমাকে ভীষন রকম ধরাশায়ী এবং ক্লান্ত করে দেয়।
এক্ষেত্রেও তাই দিয়েছে। আমি প্রাণপণ লড়ে গেছি লেখাটার সঙ্গে। শব্দগুলোকে ঘাড় ধরে
হিড় হিড় করে টেনে বার করেছি মাথা থেকে। সাজিয়েছি। যেসব আধবোজা ভাবনাগুলো আপাতত
সম্পর্কহীন হয়ে ঝুলেছিলো মনের কোণায়, সব কটাকে বাক্যে ভরে দিতে চেয়েছি মিলিটারি
প্যারেডের ঢঙে।
কিছু শব্দ পছন্দ না হওয়ায় পাল্টালাম।
দেখলাম লেখাটাও পাল্টাতে শুরু করলো। ভাবনা এবং বিষয়ে অস্বস্তি ঢুকলো। বিস্তর
অস্বস্তি। লেখাটা, আমার অন্য প্রতিটা লেখার মত, অবধারিত সরে সরে যেতে থাকলো। এমন
একটা অসহ্য দমবন্ধ করা নিয়তির দিকে লেখাটা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলো, যার আগাপাশতলা
আমার শুরু করা লেখার চাইতে আলাদা। অচেনা।
আমি হেরে যাচ্ছি। প্রত্যেকবার আমি
হেরেই যাই আমার সমস্ত লেখালেখির কাছে। এইভাবে। অসহায়। চাপা বিরক্তি, বেধড়ক রাগ আর
অস্ফুট খিস্তি মনে নিয়ে আমি লড়েই চলি লেখাটার সংগে। এখন লেখাটা একটা অদ্ভুত জায়গায়
এসে দাঁড়িয়েছে। আমি যা যা লিখবো বলে ভেবেছিলাম, তার কানাকড়িও আর এতে অবশিষ্ট নেই।
আর যেসব অসম্পূর্ন ভাবনারা ভাষায় লিখছি, অগত্যা, এইমাত্র, তার একটারও যুতসই শব্দ
আমার হাত থেকে বেরোচ্ছে না। বেরোতে চাইছে না।
সন্ধ্যে থেকে শুরু করে এখন এই মাঝরাত
পর্যন্ত চলছে লেখা নিয়ে ধস্তাধস্তি। লেখাটা ভাবছি। লিখছি। লেখা নিয়ে বাথরুম,
দু-একটা ফোনকল, কলিংবেল, রান্নাঘরে ফাজিল উঁকিঝুঁকি। সব। হাল ছাড়ছি না। এরমধ্যে,
লেখা এবং লেখাটার হয়ে না ওঠা, এই দুইই সঙ্গে করে ওষুধ খেলাম। ইন্সুলিন নীডল। রাতের
খাওয়া। কিন্তু তবুও ঠিক যা লিখতে চেয়েছিলাম তার এক ভগ্নাংশও আমি লিখে উঠতে পারিনি।
আর পারবো বলে বিশ্বাসও হচ্ছে না খুব একটা।
এলোমেলো শব্দ ভীড় করে লেখাটাকে এখন
অনেকটাই দূরে ঠেলে দিয়েছে। কি ভেবে শুরু করেছিলাম, সেসবও ভুলে গেছি এতক্ষনে।
কিন্তু হাত তুলিনি বলে সার সার অক্ষর পাশাপাশি বসেই চলেছে আঙুলের সফট টাচে।
ট্যাবের হলদে স্ক্রিনে। শেষমেশ কিচ্ছু না হলেও, না হওয়াটাই একটা কিম্ভুত হওয়া হয়ে
মোহগ্রস্থের মত আমায় দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে চলেছে এখনও। আর তাতে আমার লেখার পাতা ভরিয়ে
উঠে আসছে একের পর এক উদ্ভট এলিয়েন লেখালেখি। এদের একটিকেও আমি চিনিনা। দেখিনি
কষ্মিনকালে। আমার দূরতম অবচেতনেও এরা ছিলো বলে টের পাইনি কখনো। ট্যাবে, ল্যাপটপে,
ডেস্কটপে, মোবাইলের ক্ষুদি ক্ষুদি পর্দায়। সমানে, গতিতে, অ্যান্টিক আওয়ার গ্লাসের
অজস্র বালির দানার মত পিলপিল করে যা খুশি তাই শব্দেরা আসছে। অবয়ব নিচ্ছে। ফুটে
উঠছে অসহ্য গাম্ভীর্যে। কি, কেন, কিভাবে, সেসব ড্যব্ল্যু-এইচের কাছে এইসব শব্দেরা
দায়বদ্ধ নয়।
কিন্তু যতই এসব অসামাজিক গীত গাই বা
অজুহাত খাড়া করি না কেন, আমায় স্বীকার করতেই হবে যে, একটি লেখারও কোনো গন্তব্য,
কার্যকারণ বা কাঙ্ক্ষিত র্যুটম্যাপ আমার জানা ছিলোনা। আর জানা না থাকাটা ভয়ানক
অস্বস্তিকর বিড়ম্বনা আমার জন্য। আমার হেরে যাওয়া মুখের এবং ইচ্ছের ছবি এইসব অযাচিত
স্বয়ংভর লেখালেখি। আমার কিসসু গুছিয়ে না করতে পারার গ্র্যাফিক নভেল একেকটা লেখার
শবদেহ। যেখানে অর্থ সংজ্ঞাহীন, আর আমার নির্বোধ ক্লান্তিরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে।
লেখাগুলির সঙ্গে যে মরণপণ যুদ্ধ চলতে থাকে প্রত্যেক মুহূর্তে, তার লাঞ্ছনাক্ষত
আমার সারা শরীর আর মন জুড়ে। সে রক্তদাগ ছড়িয়ে আছে ইতিউতি শব্দগুলির নিরর্থক
সংস্থাপনেও।
কিন্তু লেখা নিয়ে আমার এই নির্লজ্জ
আত্মসমর্পণের কি কোনো শেষ আছে? এতকিছু দেখে বুঝে হেদিয়ে যাওয়ার পরেও বেহায়া আমি
আবার ফিরে যাই লেখার কাছে। আমার দৈবী পরাজয়ের কাছে। প্রতিটি লেখা হয়ে ওঠে আমার
অপমানের দিনলিপি। পরাজিতের উপাখ্যান। আর এই অর্থহীন 'উপাখ্যান' শব্দের উত্তরলেখ
রেশটুকু ধরে মনে আসে অন্য ভাবনা। যোগসূত্রহীন। লেখাটি সরতে থাকে। গ্রন্থীমোচন হয়
অনিবার্য ভাবেই। ঘুরে ঘুরে লেখা চলে যায় অন্য কোনো, এখনও না ভেবে ওঠা ভাবনার দিকে।
একটি নিখুঁত লেখাও আদল পায়না। পায়নি। অথচ, আমি অজান্তে পা বাড়াই আমার অন্য লেখাটার
দিকে। আবার। আরোও একবার।
প্রসঙ্গত, এই অন্য লেখাটাও কোথায় শেষ
হবে তার কোনো হাল হকিকৎ আমার জানা নেই। কোনোদিনই জানা ছিলো না। হয়তো প্রথম এক দু
লাইনেই এই লেখাটা শেষ হয়ে গেছে। হতে পারে যে, বাকিটায় পড়ে আছে আসলে অনেক আগে
ফুরিয়ে যাওয়া একটা লেখার বাড়তি খোলস, ছুলে ফেলা খোসা, ছাড়ানো আঁশ বা বীজ। স্রেফ
কুঁড়ো, যা কি না আমি আগে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। এমনকি যেখানে শেষ হলো সেটাই শেষ কি না, তাই নিয়েও
আমি খুব নিশ্চিত নই।
লেখা, অথবা না-লেখা সংক্রান্ত একটি
লেখা হয়তো এখানে শেষ। কিন্তু, কি জানি, শেষ সংক্রান্ত একটি লেখা হয়তো এখান থেকেই
শুরু।
##
জাংকইয়ার্ড ## ৭
যারা জিতে যায়, তারা সচরাচর বুঝতে চায়
না যে, একেকটা যুদ্ধপরিস্থিতিতে নির্ভুল জন্ম নেয় তিনটি পক্ষ। তিনখানা লম্বা
সালতামামি। তার একটি, মৃত। অন্যদুটো, পরাজিত ও ভীত।
হ্যাঁ, ভীত। সচরাচর যাকে আমরা জিতে
যাওয়া বলি। ডাকনামে ডেকে নিই শনিবারের হরির লুটে। হাতছানি দিই। আবছা সন্ধ্যেয়, টগর
আর লেবুফুলের ঝোপের পাশে। প্রদীপের কাঁপতে থাকা অন্ধকারে আর ভিজে যাওয়া বাতাসার
গোল গোল সাদায়। যারা জিতে যায়, ওই হা-ক্লান্ত মুহূর্ত থেকে শুরু হয় তাদের ভয়ের
ক্যিউব্রিক শাইনিং। পরাজিতও জিতে যেতে পারে, এমন সব নধর খুনজখমের সম্ভাবনায় লেখা
হয় আশঙ্কা। রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়। ভূত দেখে সিঁটিয়ে থাকে দিনেদুপুরে। শীত হয়ে থাকে
সারারাত। কে কখন কোথায় বাতাসা গলিয়ে দিলো বা দিতে পারে, সেসব অজানা আতংকে।
যে হেরে গেলো, তার বালাই কম। উৎসবে
আসনও পাতা নেই। রুমাল সব রক্তে ভিজে যাওয়ায় সংরক্ষণের ষাট সত্তরেও আলগা অভাজন। তবু
তার ভয় নেই। নেই কোনো ডিওডোর্যান্ট ভঙ্গিমা। ঢেউ তোলা সিক্স প্যাকস। ভাগীদার কম।
ভেঙে যাওয়া বাসর ও আমপল্লব ভেসে গেছে দিগন্ত বরাবর। আজকাল শান্তিকল্যানেও মরমীয়া
লালনের সাথে কোট পরা দেরিদা বসে থাকে পোড়ানোর ঘাটে। আঙুল জড়িয়ে বসে থাকা রস ও
জ্যুয়্যাসঁ। বুঝে গেছে বলে হেরে গিয়ে সুখী। টুকটাক গুছিয়ে তুলছে পৌষের ধান।
শালগ্রাম শিলা। চড়ুইয়ের পালক আর বিকেলের প্রলম্ব ধোঁয়া।
ওদিকে, মৃত সব এইমাত্র লিখে নেওয়া
তৃতীয় পক্ষ আগেই মুছেছে নিপুণ দায়ভার। একে একে ঘাটকাজ। স্নান করে ছেড়ে এলো জীবনের
বিশেষ্য ও বিশেষন। অনুস্বর, বিসর্গ, আর অনধিক পড়ে পাওয়া শেষ এয়োচিহ্ন। মৃতেরা অসহ
লঘুতার মত হালকা আলেয়া। জ্বলেছে। নিবেছে। রেইন ট্রি'র ত্রিমাত্রিক উচ্চতায় রাতভোর
হেঁটে যাওয়া বরাবর। মরে গেলো বলে জানতেও পারেনি কার পক্ষে লড়েছিলো মাঠে। তারপর
অবাক সংলাপে আদৌ জেগে উঠেছে কি না, আজ এই একুশের আপোরিয়া মায়ায় খুব একটা খুঁজে
দেখেনি কেউ। চুপ ছিলো। বেঁচে থেকে পায়নি কিছু মানে মরে গিয়েও পাবেনা কিছুই, এমন
আখর তো ইতিহাসই রেখেছে সাজিয়ে। আজ কাল। এখনোও।
সুতরাং, ভয় যারা পেল বা পায়, তারা সব
জিতে যাওয়া একদলা মানুষের গ্রাস। তাদের টলে যাওয়া পূর্ণশশী জোয়ারে ভাঁটায়। শেষপাতে
জারি হয় জ্যামিতির টান। অনুসিদ্ধান্ত। সাদা পাতা লিখে রাখে অনড় বিরোধাভাষ। আর,
কুহকের গোপন মায়ায় নিম্নলিখিত সিলোজিসমঃ
।। মৃত যারা, নিরুদ্বেগ, তাদের চাদরে
নীল রঙ লেখা থাকে নরম আদরে। অরণ্য
সজাগ হবে পাহাড়ের ঢালে। সে সম্ভাবনায়, পরাজিত শুতে যায় রাতের কোণায়। আর যারা জিতে
যাওয়া, ভীত মন্দভাষ। ষাঁড়াষাঁড়ির বান উন্মুখ নদীর ধারে বাস। তাদের ঘরে হরির লুটের
আঁধার এঁটো আলো। নিজের ছায়া আঁকড়ে ধরে, চিন্তা বারোমাস।।
##
জাংকইয়ার্ড ## ৮
উহাদের ঘোরাফেরা শুধু। ইতিউতি
স্বর্গ-নরক বাস। যদি কিছু জুটিয়াও থাকে, চোখে লাগে অনভ্যাসের ঝাঁস।
বর্ষায় কষ্ট লিখা থাকে। শীতে পোড়ে
রুখু সুখু আঁখি। চাহিবার সাহস জোটে নাই। আজো সে তো আওলো না সখী।
ভোট আসে, ভোট যায় ঘুরে। ফিকে হয়
আশমানি রুজ। কু ডাকে মনের গোধূলি। মনোমাঝে, অজানা অবুঝ।
পায়ে পায়ে দড়ি শুধু বাঁধা। ঠাকুর দয়াল
করো মাপ। তুমাদের মন নাই কোনো। নাই কোনো চিকন আলকাপ।
যে জ্বালাতে মরেছে কানাই, সে জ্বালাতে
আগুন দিনরাত। তাকে প্রেম বলেছো কি শুধু, ভুল করে বলো নি কি ভাত?
বর্ষা, প্রেম, ভীড়ে ঠাসা বোগি। নগরের
অলি কিম্বা, গলি। কপালে চিহ্ন লেখা থাকে। কে কানাই, কেই বা কুসুমকলি।
ত্রিপালের আধছেঁড়া ঠাঁই। রাতভোর
বাতাসের গায়ে। কানাইয়ের বাঁশি বাজে নি। পা ছিলো কুসুমের পায়ে।
তবুও নিহত সব শব। দেহখানি বেওয়ারিশ
লাশ। দায়ভার বুঝে নেয় উখা। উহ্য থাকে শোক অবকাশ।
এসকলই উহাদের কথা। আমরা তার অংশিদারও
নই। স্টিল, ফিকর করতেই হবে। যদি মানবিক কৌমতা চাই।
উহাদের শোকগাথা নাই। বেঁচে থাকা
বিরহলিপি জেনো। ঠিক কবে মরে যাবে বুঝে, ভান করে হিসেব মেলানো।
এমনই ব্যর্থতা যে সময়। এমনই সফল
কারাবাস। তার নামে সাজিয়েছি দেশ। তারই নামে যাপন বারোমাস।
মৃতবাস প্রমাদ প্রহর। শোকভারে নিরব
কনভয়। যে লবণ ইহার কান্নাজলে, জানি সেই শোক উহাদেরও হয়।
লিপি তার পাথর খুঁজে ফেরে। পাথরেরও
আছে কিছু টান। খাদানে কয়লা জেগে ওঠে। বলে, ইহারা উহারই মৃতপ্রাণ।
আরো বলে, বেলাগাম প্রিয়। মৃতেরা নাগর
পোষাকি। এ বিষম প্রমাদকালে তবে, আইসো, আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।।
নতজানু
ReplyDelete