Sunday, February 17, 2019

গ্রন্থ আলোচনা- সবর্না চট্টোপাধ্যায়






তথাকথিত ছকে বাঁধা কবিতার মেলবন্ধন নয়

২০১৭ সালে সিগনেট থেকে একটি বই প্রকাশ পেয়েছিল বড়ই বিচিত্র এক শিরনামে। নামটি আকর্ষনীয় হলেও তার রসদ সম্পর্কে ধারণা করাটা  বেশ কঠিনই ছিল সাধারণ পাঠকের কাছে। আসলে মজাটা ঠিক এখানেই । বইটি ছিল একশ শতাংশ একটি কবিতার বই। বরং বলা উচিত অধরা অনেককিছুই  কবিতার অংশ হয়ে উঠল এই প্রথম তরুণ প্রজন্মের কবি অভিজিৎ বেরার হাত ধরে।  না-বাস্তব দৈনন্দিন, বাস্তব হয়ে উঠল ‘গডজিলার নিজস্ব ইতিহাস’ নামাঙ্কিত বইটিতে।
সূচনা পর্বের কথা না বললেই নয়, যেখানে কবি লেখেন “ আমার সাথে হাঁটছে কেবল মা'র কবিতার পঙক্তিগুলি”। অদ্ভুত মায়াজড়ানো কিছু শব্দচয়নে কোথাও পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে গেল সেই না শোনা পঙক্তির অতন্দ্র যাত্রা। তারপর আসে সূচির পাতা। চোখ আটকে যায় বেশ কিছু কবিতার নাম প্রসঙ্গেই। “ লাশের ভেতর মৃত্যু”, “ ঢেউ বিক্রি করা লোকটি”, “ মাথা বদল” বা “ মশাদের যুগ” নামকরণের নতুনত্বই বলে দেয় কবির নিজস্ব আঙ্গিক। তথাকথিত কবিতার দলভুক্তি থেকে তিনি যে বেশ খানিকটা আলাদা, তা বিষয় নির্বাচনেই হোক কিংবা ভাষার প্রয়োগে বা উপস্থাপনায় সে নিদর্শন সুস্পষ্ট পাওয়া যায় “ গডজিলার নিজস্ব ইতিহাস” কাব্যগ্রন্থটিতে। 

জার্মান দার্শনিক হাইডেগার বলেছিলেন, ‘‘ভাষা কবিতার উপাদান নয়। বরং কবিতাই ভাষাকে সম্ভবপর করে।’’ এ কাব্যগ্রন্থে কবি অভিজিৎ বেরার এক একটি সৃষ্টি এক একটি বিস্ময় গড়ে তোলে। আর সেই সাথে ব্যবহৃত ভাষা ও তার প্রয়োগ যা অতি সহজেই আত্মস্থ করে পাঠক হৃদয়। দৈনন্দিন থেকে উঠে আসা ছোট বড় মাঝারি খুচরো যে কোন ব্যক্তি বা বস্তু হয়ে ওঠে কবিতার মূল চরিত্র। আর ভাষাকে কবি বিস্তার করেছেন কোনরূপ রাখঢাক না করেই। অর্থাৎ কবিতা অর্থেই তা গুরুগম্ভীর শব্দের আড়ালে ঘনঘোর রহস্যে ভরা অতি দুরূহ কিছু চিত্রকল্প হয়ে উঠবে তা কিন্তু নয়। সহজ সরল উপমায় সোজাসাপটা শব্দে যেন ঘরোয়া কথপোকথন সেরে নিতে নিতে কবি ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন গভীর থেকে গভীরে।

 কবি অভিজিৎ বেরার এই কাব্যগ্রন্থ আসলে ঠিক তথাকথিত ছকে বাঁধা কবিতার মেলবন্ধন নয় তা আগেই বলেছি। কবি প্রথাভাঙা কিছু বৈচিত্র্যকে এঁকেছেন তাঁর নিজের অদ্ভুত সব কল্পনায়। কখনও গল্পচ্ছলে বলে গেছেন “দেওয়ালেরও  কান আছে” আবার কখনও অতিসাধারণ ভাবে শুনিয়েছেন মেরুদণ্ডহীন সমাজের সুবিধা অনুযায়ী মাথাবদলের কাহিনী। কিংবা কবির ভাষায় বললে,

“ প্রত্যেকবার বাড়ি ফিরি মাথা বদল করে। এই তো গতকাল সকালে যখন বেরলাম, তখন ছিল মিনমিনে মেনিবিড়ালের মাথা, বৃষ্টিতে ভিজে যখন ফিরলাম, তখন কাকের মাথা। আর তার আগের দিন দোকানে একাশো টাকার জায়গায় পাঁচশো টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে আয়নায় দেখি গাধার মাথা। অবশ্য অফিসে বসের গালাগাল খেয়ে বেশির ভাগ দিন গন্ডারের মাথা নিয়েই ফিরি। ওটা বাড়িতেও বেশ কাজে লাগে।”

সত্যিই কি তাই নয়? কার না হয় এই মাথাবদল! হাইকোর্ট পাড়ার ভিড়ে দাঁড়িয়ে পদদলিত হয়ে মরার আগে জেগে ওঠে কাপুরুষের মানুষ স্বত্ত্বা। কিন্তু কতদিন? কতবার এই মৃত্যুর আগে জেগে ওঠা? পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়েটির ছটফটানিকে খুঁজে বেড়াতে আগ্রহী, এমন মানুষই বা আজকের দিনে কোথায়? যে ব্যালকনি আমাদের নিউক্লিয়ার নিঃসঙ্গতায় একটুকরো রোদ এনে দেয়, ভাঙা বসন্তের হাওয়ায় জোড়া শালিকের আড্ডার আসর জমায় সেই ব্যালকনিকে মৃত্যু উপত্যকা ভাবতে আজকের স্বার্থপর মানুষের কোথাও একটা বিরাট ধাক্কা লাগে। কেঁপে ওঠে টিপটপ সাজানো ফ্ল্যাটের ঘর। ছিমছাম আমি তুমি ব্যস্ত জীবন। কবির সার্থকতা এখানেই যে এক মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি স্থিমিত করে দেন সেই শান্তির বহমানতা। ভয়ে কেঁপে ওঠি। সেই বিমর্ষ গরিলার ছায়া কি কোথাও আমাদের সংসারে লুকিয়ে নেই ?

এক জায়গায় কবি লেখেন, “ ঢেউ বিক্রি করে লোকটির সংসার চলে। এই ধরো তুমি সমুদ্রে বেড়াতে গেছ অথচ সমুদ্রে ঢেউ নেই। ওকে বোলো। ও ঢেউ বানাতে পারে। তবে ঢেউ প্রতি ও টাকা নেয়। তুমি যখন ঢেউয়ের আনন্দ নেবে, তখন বিচে এক মহিলা স্টপওয়াচ নিয়ে ঢেউ গোনে। সে ওর স্ত্রী। উঁহু, একটা ঢেউ এদিক- ওদিক হবার জো নেই।”

কোথায় আজ এমন কল্পনা যেখানে সেই মানুষটির খোঁজ রাখে কেউ যে ঢেউ এনে দেয় নিস্তরঙ্গ শুকনো বালির বুকে!  সত্যিই কি মানুষের ইতিহাসে সুনামির চেয়ে দীর্ঘজীবী ঢেউ আর আছে? তবু সমাজ দলিতকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিটা সময়। তাদের অভিমান রাগ জেদ যদি কোনদিন ফুলে ওঠে পাহাড়ের মতো, ফেটে পড়ে আগ্নেয় স্রোত তবে কি সে প্রতিবাদ সুনামির নাম পাবে? সে সংশয় কবিরও! যেন সারাদিনের জমানো কষ্ট দিনের শেষে জড়ো হয় ভল্টে। বছর দশ পর হয়ত যাদের মূল্য ঝাঁটায় লেগে থাকা ঝুলের সমান।
অবাক হতে হয় কবির প্রতিবাদের ধরণ দেখলে। যেখানে উনি লেখেন, “ আজকাল সবাই দেখি বাবাকে বেচে দিচ্ছে,  যেন এটাই ফ্যাশন। বড় রাস্তার ধারে প্রত্যেকটা গাছের নীচে একটা করে বাবা। বাবারা কি জানত একদিন যে ছোট চারা ওরা সযত্নে পুঁতেছিল, সেই চারা একদিন এত ‘ বড়’ হয়ে উঠবে? একটা গাছের মতো ‘বড়’?”

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ দর্শনে। বিবেক দংশন হয়। যন্ত্রণায় তীব্রতায় কাতরাতে থাকে স্থির পাঠক যেন চুপিচুপি কেউ এসে সপাটে নাড়িয়ে দিয়ে যায় দুটো কান। কবির লেখনীতে কখনও প্রধান হয়ে উঠছে রোজকার ব্যবহারের টুথব্রাশ আবার কখনও সামান্য একটি ক্ষুদ্র কীট মশা। সেই মশারা ঘিরে আছে আক্রমণকারীর মতো। আবার যখন তিনি লেখেন, “ প্রতিটি মানুষের চারিদিকে সমুদ্র থাকে। আর তারা দুদিন পরপর দ্বীপ পালটায়। সমুদ্রের স্মৃতিশক্তি প্রবল, সে ঠিক মনে রাখে কোন দ্বীপ থেকে কে কোন দ্বীপে যাচ্ছে”, কেমন ঝড় শুরু হয় ভেতরে ভেতরে। ভাঙা ডিঙি ওল্টে আসে ।ঝরা পাতায় টোকা দেওয়া শৈশব, কৈশোর, যৌবন।মানুষকে ঘিরে ধরে শুধু জল, মৃত শেল ফিশের খোল। অসামান্য অনুভূতির ছত্রছায়ায় কবি লিখে চলেন তার ইতিহাস।

কবির কল্পনা যখন জল নিয়ে, শহরের কোণে পড়ে থাকা একটি পরিত্যক্ত ভূতবাড়ি নিয়ে কিংবা নিজের সাথেই তখন বারবার আমরা ফিরে ফিরে দেখি দর্শন যেখানে আমাদের ভেতর আর বাইরেটা আলাদা হতে থাকে রোজ একটু একটু করে নিজেদের কর্মব্যস্ততায়, স্বার্থপরতায়, উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। ঠিক সেই জায়গায় আবার তার কলমে উঠে আসে এক মৃত্যুহীন স্বপ্নের কথা। “ ঘুমের মধ্যে যাদের মৃত্যু হয়” কবিতাটিতে তিনি মৃত্যুহীন স্বপ্নের চিরকালীন যাত্রার কথা বলেন।

“ ফ্যারাওয়ের চিঠি” কবিতাটিকে একটি অন্যতম শক্তিশালী উপস্থাপনা বলা যেতে পারে। লেখাটিতে ওঠে আসে সমাজের নীচু তলার দাসত্বের কথা। উন্মুক্ত নাবিকের স্বপ্ন চোখে নিয়ে যারা কাটিয়ে চলেছে তাদের বদ্ধ মৃত জীবন। আবার “ রাজনীতি” কবিতাটির মধ্যে দখলের ঘৃণ্য দমননীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন তাও খুবই নতুনভাবে। নতুন নতুন চিত্রকল্পে চেনা গন্ডী ভেঙে জমি দখলের রাজনীতি শেখাচ্ছেন পাইথনের রূপ ধরে।
অবাক হতে হয় যখন পড়ি “ বইয়ের ব্যারিকেড”। কি অভিনব এক উপস্থাপনা। কবর খুঁড়তে খুঁড়তে বইপাগলদের আনন্দে মেতে ওঠা কিংবা পুরোনো বইয়ের গন্ধে উন্মাদ হয়ে ওঠার মতো ছোট ছোট পংক্তিগুলি কৈশোর যৌবন মনে করায়। আর সাথে সাহিত্যের বিপুল সম্ভার যে আদপে রক্তবীজের ঝাড় তার তার ইঙ্গিত রেখে কবি লেখেন, “ পৃথিবীর ইতিহাসে তো কম বই লেখা হয়নি”।       

শিল্পী মার্ক শাগালের কথায়, “ If you want to touch people's hearts, you must weep softly.” এই নম্রতা, অতি সাধারণ কথোপকথন, এমনকি ছোটখাটো টুকিটাকি জাগতিক বস্তুর উপস্থিতি কখন যেন জলের মতো ঢুকে পড়ল পাঠকের মনের ফাটলগুলোয়। নিকষ কালো অন্ধকারে বারবার কেঁপে ওঠা অগ্নিশিখার মতো পোড়াতে সামর্থ এই অভিনব সৃষ্টি। কোন এক পাহাড়ি রীতিকে কবি যখন উজ্জাপন করেন “রাজপুত্র” নাম দিয়ে যেখানে রাজার ছেলে হওয়ার আনন্দে শহরবাসী গাছ লাগিয়ে, তখন তার ধারালো লেখনীর সাথে সাথে চতুরতার পরিচয়ও পাওয়া যায় পুরোমাত্রায়। সমাজের ভালোর দিকটা যিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে আলোয় নিয়ে আসেন পাঠকসমাজের।
অতি সাধারণ ভঙ্গিমায় অভিনব যুক্তিতে চিত্রিত এই লেখাগুলি তাই সহজেই গেঁথে গেল পাঠক হৃদয়ে। কবি পুরষ্কৃত হলেন কৃত্তিবাস সম্মানে। আসলে কবিতা হল “  The social act of a solitary person. ” অর্থাৎ প্রতিটি কবিতার সম্প্রসারিত জীবনবোধই রচনা করল “ গডজিলার নিজস্ব ইতিহাস”। 

গডজিলার নিজস্ব ইতিহাস
অভিজিৎ  বেরা
সিগনেট প্রেস
১০০ টাকা

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাব...