Wednesday, February 20, 2019

২১শের দীপ জ্বালাও: অমর মিত্র


                    
                  ২১শের দীপ জ্বালাও

   আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমার মাতৃভাষা বাংলা, আমি বলব সমস্ত মাতৃভাষার  কথা। আমি বলব,  ককবরক, অসমীয়া, ডিমাশা, মনিপুরী থেকে হিন্দি, গুজরাতি, তামিল তেলেগু----সব ভাষার কথা ।  নিজের ভাষা বাংলার কথাও বলতে চাই। ভাষাই হলো যে কোনো জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্ম পরিচয়ের প্রধান উপাদান। চিহ্ণ। যে জাতি নিজের ভাষা, মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলে, সে জাতি দুর্ভাগা। সে জাতি হয় আত্মপরিচয়হীন, অন্যের পরিচয়ে সে বাঁচে। সে বাঁচা অন্যের গলগ্রহ হয়ে বাঁচার মতো বলা যায়। যে জাতি নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলে, বা যে জাতির মুখের ভাষা, মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া হয় সে জাতি পদানত হয়েই থাকে।

     এখন যা বাংলাদেশ ১৯৭১-এর ২৬শে মার্চ আগে যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান, সেখানকার মানুষ নিজের ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে, অবিরল অসম্মানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় একটা দেশেরই জন্ম হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে নেইই প্রায় এমন বিরল ঘটনা।  আমাদের এই ভারত দ্বিখন্ডিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের জন্ম সেই দ্বিজাতিতত্বকেই নস্যাত করে দিয়েছে। মিথ্যা প্রমাণ করেছে। প্রমাণ করেছে, ধর্মের চেয়েও ভাষার জোর বেশি। এই সব কথা সকলেই জানেন, অন্তত যাঁরা ভাষা নিয়ে ভাবেন তাঁরা। পাকিস্তান জন্মাল ১৯৪৭-সালের আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে। পূর্ব পাকিস্তানের পরের মাসেই, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিবাদ শুরু হয়ে যায়। বাংলা না উর্দু। সেই সময়ে পাকিস্তানের ডাক টিকিটে, রেলের টিকিটে উর্দু এবং ইংরেজি লেখা থাকত।
  
সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদনের ভাষাও ছিল উর্দু কিংবা ইংরেজি। অথচ পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। উর্দু ছিল ৫ % মানুষের ভাষা, যাঁদের বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের শাসকরা বলতেন বাংলা মুসলমানের ভাষা নয়। বাংলা ভাষার ভিতরে নাকি হিন্দুয়ানির গন্ধ লেগে আছে। এ থেকে অসন্তোষ শুরু হয়। একটা দেশ জন্মাল দুই প্রান্তের মানুষের ভিতর বিবাদ আরম্ভ হয়ে গেল। নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের শিক্ষা সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ প্রস্তাব নেয়।  শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সংবলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার অনঢ় ছিল তার সিদ্ধান্তে।  ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের  কুমিল্লা থেকে  নির্বাচিত গণ পরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে গ্রহণ করার জন্য এক বিল আনেন পারলামেন্টে। জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন । পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয় । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দমে না যেয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনী সহ বিলটি পুনরায় উত্থাপন করেন কিন্তু প্রতিবারই  তা বাতিল হয়। পূর্ব পাকিস্তান দমেনি। আন্দোলন প্রতিবাদ সংগঠিত হতে থাকে। দাবিপত্র পেশ করা হতে থাকে।   ২১শে মার্চ ১৯৪৮ -এ  ঢাকার  রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা"। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে ওঠে। জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন।  ২৪শে মারচ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ "ষ্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং" শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ক্যাটেগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে বলেন "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে। পূর্ব বঙ্গ তখন ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-র দিকে যাত্রা করেছে। দিনলিপি এমন হতে পারে।
  
 ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫২ ঃ  The Basic Principles Committee of the Constituent Assembly of Pakistan পুনরায় উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে এ্যাসেম্বলীতে চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রদান করে ।  শান্ত পূর্ব বঙ্গ ক্রমশ অশান্ত হয়ে যেতে থাকে। ভাষা নিয়ে এই আন্দোলন থেকে আসে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। পাকিস্তানের পশ্চিমী শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গের ভাষার দাবী ক্রমশ বৃহৎ হয়ে যেতে থাকে। জিন্নার না, পূর্ব বঙ্গের হ্যাঁ, জিন্নার উর্দু, পূর্ব বঙ্গের বাংলা অগ্নিগর্ভ করে তোলে পূর্ব পাকিস্তানকে। 
       ২৭শে জানুয়ারিঃ ঢাকা সফররত পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । সাথে সাথে সমাবেশস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শ্লোগান ওঠে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" । এই বক্তব্য সমগ্র পূর্ব - পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।
   ২৮শে জানুয়ারিঃঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে । এই সমাবেশ থেকে নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপরিষদকে পশ্চিম পাকস্তানের হাতের পুতুল হিসাবে অভিহিত করা হয় ।
 ৩০শে জানুয়ারিঃ খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য ভাষা আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দান করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইদিন সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয় ।
একই দিন মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় ভাসানীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি আওয়ামী মুসলিম লীগের সরাসরি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
    ৩১শে জানুয়ারি ঃ  ভাসানীর সভপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে ।
    ৪ফেব্রুয়ারিঃ ছাত্রদের  ডাকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বত:স্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয় । ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবীতে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় একটি মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে ।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ : পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারী ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।
 ২০শে ফেব্রুয়ারিঃপাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে আবুল হাশিম এর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারা ভংগ করার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সভার একটি বড় অংশ ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে মত দিলেও অনেকেই এতে সহিংসতার আশঙ্কায় বিপক্ষে মত দেন ।
 ২১শে ফেব্রুয়ারিঃ সকাল ৯টা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু ।
সকাল ১১ টা : কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু । সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় । আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার ব্যাপারে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন ।
বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা : উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন । এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয় । এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে । গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃত্যু বরণ করেন । পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন মৃত্যু বরণ করেন । অহিউল্লাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায় । পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয় ।
বেলা ৪টা : ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে ।] গুলিবর্ষনের সংবাদ আইন পরিষদে পৌছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ছয়জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবী করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্য মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকেঅনুরোধ করেন । সরকারী দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকন্ঠ হন কিন্তু নুরুল আমিন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন । এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন ।  রাতের বেলা ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও ক্লাবে পরদিন সকালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হবার আহবান সংবলিত লিফলেট বিলি করা হয় ।
     ২২শেঃ  হাজার হাজার ছাত্র জনতা সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়ো হতে থাকে । উপস্থিত ছাত্র-জনতা ২১ ফেব্রুয়ারীনিহতদের স্মরণে কার্জন হল এলাকায় একটি জানাজা নামাজ আদায় করে এবং একটি শোকমিছিল বের করে । শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ চারজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন । উত্তেজিত জনতা রথখোলায় অবস্থিত সরকারপক্ষীয় পত্রিকা "দি মর্নিং নিউজ " এর অফিসে আগুণ ধরিয়ে দেয় । নুরুল আমিন পুলিশের পাশাপাশি আর্মি নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে । আর্মি ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক) এ জমায়েত হয় এবং সেখানে অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব ব্ক্তব্য রাখেন ।
উপায়ন্তর না দেখে নুরুল আমিন তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাশ হয় ।
    ২৩শেঃ সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে স্বত:স্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালিত হয় । এর আগের দিন আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব আনার পরেও নুরুল আমিনের পেটোয়া বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর দমন পীড়ন অব্যহত রাখে । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৫ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বরকত শহীদ হওয়ার স্থানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে ।
 ২৪শেঃ ভোর ৬টার সময় "শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের" নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় এবং সকাল ১০টার দিকে শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির ফলক উন্মোচন করা হয় । নুরুল আমিনের সরকার রাজপথে সর্বত্র সেনাবাহিনী এবং পুলিশ মোতায়েন করে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিবেশ স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয় । এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেফতার করা হয় ।
   ২৫শেঃ ছাত্র বিক্ষোভকে দমাতে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ।

  এরপরও  ভাষা নিয়ে পশ্চিমীদের বিরোধিতা চলতে থাকে। ১৯৫৬ তে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে স্বীকার করা হয়েছিল বটে, কিন্তু পশ্চিমীদের ঘৃণার অবসান ঘটে না।ক্ষমতার ভাষা উর্দু দিয়েই তাঁরা শাসন করতে চাইতেন।  আয়ুব খাঁ যখন সামরিক শাসক, রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল পূর্ব বঙ্গে। ভাষা এবং সাংস্কৃতিক দখলদারিই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙে দেয়। নতুন দেশের জন্ম হয়।
  ভাষা হলো যে কোনো জাতি-জনগোষ্ঠীর আত্মসম্মানের বড় জায়গা। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরে ১১জন মানুষ ভাষার দাবিতে আত্ম বিসর্জন করেন। অধিকার সেই বাংলা ভাষা। শিলচরের ঘটনাও ২১শের মতো চরম বেদনাদায়ক। নিন্দার্হ। আসামে এই সমস্যা মেটেনি। বরং বেড়েছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর ত্রাসে বাঙালি নিজের ভাষা ত্যাগ করে অসমীয়া হয়ে যেতে চাইছে। এই ভয়ানক  ত্রাস রোধ না করলে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হবে। অথচ  এই ভারতে  সব ভাষা, এখন ২৩টিই হলো রাষ্ট্রভাষা। হিন্দি এবং ইংরেজি  হলো রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা। এই ভারতে নোটের উপর সব ভাষা উদ্ধৃত থাকে। সাহিত্য অকাদেমি, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট সব ভাষাকেই সমান মর্যাদা দেয়। এই ভারতে সব ভাষাই বিকশিত হয়ে ওঠার কথা। তা যদি না হয়, দেশ আর দেশ থাকবে না। মনে রাখতে হবে,  ককবরক এবং হিন্দি উর্দু তামিল বাংলার একই অধিকার।

    ১৯৯৮ সালে্র জানুয়ারি মাসে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার নিবাসী দুই বাংলাদেশের নাগরিক ( পরবাসী ) রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম জাতিসঙ্ঘের মহা সচিব কফি আনানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তাতে উল্লেখ করেন সমগ্র বিশ্বে  অনেক ভাষা চর্চার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাছে। গরিষ্টের ভাষা লঘিষ্ঠের ভাষাকে গ্রাস করছে। মাতৃভাষা মানব জীবনের পক্ষে অপরিহার্য। মানুষের আত্মপরিচয় মাতৃভাষা দিয়েই নির্ধারিত হয়। এই কারণে সমগ্র বিশ্বে একটি দিনকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা স্মরণ করে ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস হিশেবে পালন করা হোক। এরপর এঁরা ভিন্ন ভাষাভাষী দশজনকে নিয়ে গঠন করেন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’। এদের আবেদনে  নানা পদ্ধতির ভিতর দিয়ে গিয়ে ১৯৯৯ ১৭-ই নভেম্বর ১৮৮টি দেশের সমর্থনে ইউয়েনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিশেবে ঘোষণা করে। প্রস্তাব সমর্থকের  ভিতরে পাকিস্তান এবং চিনও ছিল। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে সমস্ত পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। হ্যাঁ, পাকিস্তানেও। উর্দু ভাষাভাষী মানুষও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করবেন। একথা সত্য যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ভাষা। গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমান বিশ্বে ছ’হাজারের মতো ভাষা বিলুপ্তির মুখে। প্রতি দুসপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। কত জনজাতির কত ভাষা। মুখের ভাষা আছে, লিপি নেই। সংখ্যা গরিষ্টের ভাষা গ্রাস করছে সংখ্যা লঘিষ্টের ভাষা। এই প্রবণতা থেকেই কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম হয়। এই দেশ বহুভাষিক। পরিচিত ভাষা ব্যতীত অচেনা ভাষা আছে কত জনজাতির। তা রক্ষা করাই ২১শে ফেব্রুয়ারির দায়িত্ব। বাংলাদেশের আদিবাসিজন, সাঁওতাল, মুন্ডা, চাকমা, পার্বত্য জাতিদের ভাষার কথা সেদেশের মানুষ ভাববেন। তবেই ২১শের দীপ সকলের হৃদয়ে জ্বলবে। এই দেশে রাজ্যগুলি ভাগ হয়েছে ভাষা ভিত্তিক।   সব ভাষা যদি সমান মর্যাদা না পায়, তবে ক্ষোভ জন্মাবে। আবার রাজ্যের ভিতরেই কত ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর ভাষা আছে। কুরমালি, সাঁওতালি,মুন্ডারি, রাজবংশী, হাজং ভাষা, গারো ভাষা, হো, কোল, ভীল, রাভা জনগোষ্ঠীর ভাষা, কোথাও লিপি আছে, কোথাও লিপি নেই, হারিয়ে গেছে। সেই সব ভাষাকে বিকশিত হতে  না দিলে ২১শের দীপ জ্বলবে না। ক্ষমতাবানের  ভাষার ( যেমন ধরা যাক হিন্দি, রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা বলে চালিয়ে দেওয়া হয় ) দখলদারি থেকে মাতৃভাষাকে মুক্ত করতে হবে।  আর দেশ যে উদ্বেগের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ভাষাই হবে, মানুষের পরিচয়, ধর্ম নয়।  তবেই আমরা বাঁচব।


   

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাব...