Sunday, February 17, 2019

গ্রন্থ আলোচনা- সাক্ষীগোপাল কুণ্ডু


   

      উপন্যাস অথবা নিছক ভূতের গল্প

অনির্বাণ বসু, হাঁকামনা, কলকাতা : ধানসিড়ি প্রকাশন, অক্টোবর ২০১৮, ৮০ টাকা

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস্ অফ সলিট্যুড উপন্যাস শুরু করেছিলেন এইভাবে : 'Many years later, as he faced the firing squad, Colonel Aureliano Buendia was to remember that distant afternoon when his father took him to discover ice.' কাল সম্পর্কে আমাদের পরিচিত, সাধারণ ধারণাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল সেই উপন্যাসের সূচনাবাক্য; বহু বছর পরের এক সম্ভাব্য দিনে স্মৃতির ফিরে আসা জনিত সেই ভবিষ্যৎবাণীর মধ্যে একই সঙ্গে খেলা করেছিল অতীত এবং ভবিষ্যৎ কাল নির্দেশক ক্রিয়াপদ। ১৯৬৭ সালে সেই উপন্যাস প্রকাশের পঞ্চাশ বছর পার হয়ে এসে, নয়া-উপনিবেশবাদের গুঁতোয় ক্রমশ অবলুপ্তির পথে হাঁটতে থাকা একটা ভাষায় লেখা হল এমন সূচনাবাক্য : 'বহু বছর পর বেতের ইজিচেয়ারটার সামনে দাঁড়িয়ে একাকী নিঃসঙ্গ অনন্যর মনে পড়ে যাবে সেই পুরাতাত্ত্বিক গহিন আঁধারের আলোছায়ার লীলাকমল, যখন তার মনে ভীতির জন্ম দিয়েছিলেন তার প্রগাঢ় মাতামহী।'

সমাপতন? কাকতালীয়? প্রেরণা? শিল্পিত চুরি? আন্তর-পাঠসংযোগ? কী বলব আমরা? যে-পৃষ্ঠা থেকে উপন্যাসের কাহিনি শুরু হচ্ছে, তার পাশের, অর্থাৎ আগের পৃষ্ঠাটি বরাদ্দ করেছেন লেখক ঋণস্বীকারের জন্য, যেখানে চতুর্থ নামটিই গার্সিয়া মার্কেজ-এর। কাহিনি যত এগোয়, বোঝা যায়, লেখক সচেতনেই তাঁর পূর্বপাঠের অভিজ্ঞতাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করার ব্যাপারে নির্দ্বিধ।
     
উৎসর্গপত্রের পর ফ্লাই-লিফে লেখক একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে নিজের অভিসন্ধি জানান আমাদের : নিটোল কোনও গল্প, যাকে চলতি বুলিতে 'গোলগল্প' বলা যায়, যার যে-কোনও পৃষ্ঠা খুলে পড়তে বসা যেতে পারে যে-কোনও সময়ই, তা নয়; এই উপন্যাসে প্লট নয়, আখ্যানই মূল লক্ষ্য লেখকের : 'Plot is for those who already know the world; narrative is for those who want to discover it.'

আমাদের আলোচ্য এই আখ্যান এক পাণ্ডববর্জিত ভূখণ্ডের প্রায় আড়াইশো বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক দলিল। ক্রাউন সাইজের আটত্রিশ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস শুরু থেকেই বুনে দিতে চায় সুর্নির্দিষ্ট প্রতিবেশকে, যে-পরিবেশ জুড়ে 'দেশের মাটি জল ফুল ফল পতঙ্গ গাছগাছালি ডিঙিনৌকা নদী দীঘি পুকুর এঁদোডোবা কচুরিপানা গোয়ালঘর গাই বাছুর বলদ লাঙল মড়াই ঢেঁকি বরোজ লম্ফ কুপি তুলসীমঞ্চ ঠাকুরদালান দুর্গাবাড়ি চণ্ডীমণ্ডপ আখড়া আলপনা লক্ষ্মীছাপপদচিহ্ন হাতপাখা আসনপিঁড়ি জলচৌকি জামবাটি তালপুথি টোল নকশিকাঁথা মেঠোপথ আলপথ ধানক্ষেত পাটক্ষেত নালিঘাস দুর্বাঘাস' --- আমাদের স্বপ্নের দিন, পল্লিবাংলা, অবিভক্ত বঙ্গদেশকে। এই আশ্চর্য ভ্রমণের সফরসঙ্গী হিসেবে প্রথমে দিদিমা, পরে মা এবং একটা সময় পর প্রেমিকাকে পায় উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র অনন্য। কৃশতনু এই উপন্যাসে প্রোটাগনিস্ট এবং অ্যান্টাগনিস্ট, কে যে কোনটা, ঠিকমতো বুঝে ওঠা যায় না; কেন্দ্র এখানে স্থির থাকলেও, বদলে-বদলে যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র : কখনও অনন্য হয়ে যায় প্রোটাগনিস্ট, কখনও-বা তাকে সরিয়ে প্রবল হয়ে ওঠে হাঁকামনা। 
     
হাঁকামনার গল্প ছেলেবেলায় দিদিমার কাছে শুনেছিল অনন্য। হাঁকামনাকে কখনও দেখেনি সে, শুধু শুনে গেছে। কৌতূহল বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গড়ে নিয়েছে তার কল্পিত অবয়ব। এই হাঁকামনা, বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের লোকগল্পে যাকে 'একানড়ে' বলে, আসলে তা-ই; পূর্ববঙ্গীয় কথকতায় 'হাঁকামনা'-র চলটাই বেশি। কোন-এক বিস্মৃত বালকবেলায় অনন্য প্রথম শুনেছিল হাঁকামনা-র গল্প, সেই প্রথম ভয় জন্মেছিল তার মনে। বাল্যের সেই প্রথম ভয় থেকে আর কখনওই বেরোতে পারেনি সে। বেরোতে পারেনি, নাকি তাকে খুঁজে পেতে চেয়ে ভুলতে পারেনি? হাঁকামনা-কে খুঁজতে গিয়ে অনন্য বেরিয়ে পড়ে অনির্দেশ্যের উদ্দেশে, আর তার সেই সন্ধান-প্রক্রিয়ার পরতে-পরতে উঠে আসতে শুরু করে পাণ্ডববর্জিত সেই ভূভাগের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের ধূলিধূসর ছিন্নপত্র। দিদিমার মুখে শোনা হাঁকামনা-র ভয়-সন্ত্রস্ত গল্পের পর অনন্য খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে সেই না-দেখা শরীরী কিংবা অশরীরীকে, গোটা উপন্যাস জুড়ে সে শুধু এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে বদলে যায় পাঠকের ভাবনাবিশ্বে : '...অনন্য দেখে তার মায়ের মৃতদেহের পাশেই দেয়ালা করে চলেছে এক অভিশপ্ত দেবশিশু; সে-শিশুর মুখসৌষ্ঠব অবিকলছাপ তার মায়ের মুখশ্রী;...উপস্থিত কোনও-একজনের কথায় সে জেনে ফেলে : এই সন্তান অপয়া; জন্মের সঙ্গেই নিজের মাকে খেয়েছে সেই সদ্যোজাত; অনন্য তখন মনে-মনে সেই সন্তানের নাম দেয় হাঁকামনা...।

'...সে দিদিমাকে তার হাঁকামনা সন্ধান ও প্রাপ্তির কথা বললে, দিদিমা মুখ তোলেন এবং নাতিকে অবাক করে তিনি জানান যে, কিশোর অনন্য ঘাড়ে করে যাকে বয়ে নিয়ে এসেছে, সে তারই আশৈশব;...।'

এইভাবেই উপন্যাসে হাঁকামনা তার স্থান এবং চরিত্র বদল করে বারংবার। কখনও সে অনন্য হয়ে সামনে আসে, কখনও ফোকলা দাঁতের দিদিমার স্বরূপে, কখনও-বা শোষণের যন্ত্র রাষ্ট্রের চতুরালির ছদ্মবেশে। 
     
রাষ্ট্রকে প্রায় সরাসরি লেখক বসিয়ে দেন হাঁকামনা-র ভয়াল রূপের জায়গায়। ক্যালাইডোস্কোপের মতো ছোটো-ছোটো কিছু কোলাজ উঠে আসে যা আসলে প্রায় আড়াইশো বছরের ইতিহাস, যা ভয়ংকর হলেও সত্যি, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। ইতিহাসের সেই ট্র্যাজিক উল্লাসে তেভাগা থেকে এক পয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ঊনষাটের খাদ্য আন্দোলনের পাশে ছেচল্লিশের ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার নরমেধ যজ্ঞ, নকশালবাড়ির সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পাশে নন্দীগ্রাম --- এসে মিলে যায় অক্লেশে, অকাতরে। হা-ক্লান্ত পথিকের চোখ দিয়ে আমরা দেখি, বদলে যাচ্ছে পুরোনো কলকাতা, ভেঙে চুরচুর করে দেওয়া হচ্ছে ঐতিহ্যের সুবিশাল প্রাকার --- সেনেট হল  : 

'তোমাদের শেষ নেই, তৎপর কর্ণিক নিয়ে হাতে
সংস্কারপান্থ, হে বন্ধু, ভেঙে যাচ্ছ পুরোনো কলকাতা
সেনেটের ষাট সাল বুকে তুলবে তুলসীধারা রাতে
সহসা ঝড়ের মাঝে আশ্রয়ার্থে দেখব না তোমায়।'

ইতিহাসের এমনই বহু ছোটো-ছোটো অধ্যায়কে আখ্যানের চলনের পাশে থরে-বিথরে সাজিয়ে দিয়েছেন লেখক। এইসব চলমান ছবিগুলো আখ্যানের সমান্তরাল ইতিহাসকে সহজেই তুলে ধরে আমাদের সামনে। এই আখ্যান প্রকৃত প্রস্তাবে ভয়ের আখ্যান; ভূতের নয়। অনন্যর মনে হাঁকামনা-র ভয়। সে-ভয় রয়ে গেল, বেড়ে উঠল, ফিরে এল, উড়িয়ে নিয়ে গেল এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায়। এ-উপন্যাস সেই গল্পের ভিতর, সুড়ঙ্গ থেকে সুড়ঙ্গান্তরে, জীবন থেকে মৃত্যুর গোলোকধাঁধা পেরিয়ে, জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে কমরেড খোঁজার অগস্ত্যযাত্রা। আমাদের একটা গল্প ছিল; গল্প, নাকি সত্যি, নাকি ইতিহাস, নাকি ভালোবাসা, নাকি কাব্য, নাকি স্বপ্ন --- যা অনন্যকে তাড়িয়ে ফেরে। এ-ভয় আসলে যে-কোনও মানুষেরই। এ-ভয় আসলে যে-কোনও সময়েরই।    




No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"একটা কথা আমি বলি। আমরা অনেকগুলো জিনিস খবরের কাগজে দেখি। সারফেসে দেখি, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। আমাদের আর কিন্তু প্রভাব...